বিশেষ প্রতিনিধি, বিজনেসটুডে২৪
আনোয়ারা ( চট্টগ্রাম ) থেকে: গহিরা নামটি শুনলেই যেন নোনতা হাওয়ার গন্ধ ভেসে আসে। আর গহিরার বিশেষ ঐতিহ্য — লইট্টা মাছ — আজও রসনাবিলাসীদের কাছে অতুলনীয় এক আবেগের নাম। কর্ণফুলী নদী আর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় লইট্টা মাছের প্রাচুর্য গড়ে তুলেছে গহিরার নিজস্ব মৎস্য ঐতিহ্য।
প্রতিদিন ভোরে, যখন সূর্যের প্রথম কিরণ ছুঁয়ে যায় সমুদ্রপাড়, তখন থেকেই শুরু হয় জেলেদের নৌকা বেয়ে মাছ ধরার ব্যস্ততা। তাজা লইট্টা মাছের গন্ধে ভরে ওঠে পুরো গহিরা। এখানকার লইট্টা মাছ বিখ্যাত তার স্বাদ, কোমলতা আর স্বতন্ত্র গন্ধের জন্য। বিশেষ করে শুঁটকি রূপে এই মাছের কদর শুধু চট্টগ্রামেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে — এমনকি বিদেশেও।
গহিরার লইট্টা মাছ সংগ্রহের পর শুরু হয় আরেকটি মহাযজ্ঞ — মাছ শুকানোর প্রক্রিয়া।
শুঁটকি শ্রমিক রওশন আরা বেগম বলেন,”লইট্টা শুকাতে গেলে খুব সাবধানে কাজ করতে হয়। নাহলে মাছ নষ্ট হয়ে যায়। আমরা পরিষ্কার করে রোদে শুকাই, তারপর সংরক্ষণ করি। এই কাজই আমাদের জীবন।”
আরেক শ্রমিক ইসমাইল মাঝি জানান,”আমি ছোটবেলা থেকে বাবা-চাচার সাথে শুঁটকি বানাই। গহিরার লইট্টা মাছের গন্ধ, স্বাদ — আলাদা। যারা একবার খায়, আবার আসে।”
মাছ শুকানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন বহু নারী-পুরুষ। সূর্যের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজের পরই তৈরি হয় একেকটি উৎকৃষ্ট লইট্টা শুঁটকি।
গহিরার লইট্টা মাছ এখন শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, চট্টগ্রাম শহরের বড় বড় বাজার এবং ঢাকাতেও সরবরাহ হয়। পাশাপাশি, রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, লইট্টা মাছ প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর, বিশেষ করে যারা সমুদ্রের আসল স্বাদ খুঁজছেন তাদের জন্য আদর্শ।
স্থানীয় কয়েকজন গর্বভরা কণ্ঠে বললেন, “লইট্টা মাছ শুধু পেটের খোরাক নয়, আমাদের গর্ব।”
এই কথার ভেতর লুকিয়ে আছে গহিরাবাসীর জীবনসংগ্রাম, আবেগ আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক গভীর ইতিহাস।
গহিরার মানুষদের কাছে লইট্টা মাছ মানে শুধুমাত্র খাদ্য নয় — এটি জীবিকার প্রধান অবলম্বন, সুখ-দুঃখের সঙ্গী, আর তাদের আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রতিদিন ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শত শত জেলে নেমে পড়েন সমুদ্রে, মাছ ধরার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এই লইট্টা মাছই তাদের ঘর আলো করে, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালায়, উৎসবের আনন্দে মুখর করে তোলে গ্রাম।
একটি ছোট মাছ হয়তো কারও কাছে সাধারণ, কিন্তু গহিরার মানুষের কাছে এটি — আশা, সংগ্রাম আর সম্মানের প্রতীক।
তাদের কাছে লইট্টা মাছের প্রতিটি রূপ — তাজা, শুঁটকি বা রান্না করা অবস্থায় — জীবনের নানা স্মৃতি বয়ে আনে। উৎসবে, অতিথি আপ্যায়নে, এমনকি প্রবাসে থাকা আত্মীয়দের জন্য পাঠানো উপহারের মধ্যেও লইট্টা থাকে গহিরার অদৃশ্য এক মমতার সুতো হয়ে।
আর তাই স্থানীয়রা যখন বলেন, “লইট্টা মাছ আমাদের গর্ব,” তারা আসলে বলেন তাদের আবহমান জীবনচিত্র, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা আত্মমর্যাদার কথা।