আজহার মুনিম, লন্ডন: লন্ডনের বাতাসে এখন এক ধরনের কড়াকড়ির গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। যে শহর একসময় নিজেকে বিশ্ব নাগরিকদের স্বর্গ বলে মনে করত, সেই শহরই এখন অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার বলছে, গত এক বছরে অবৈধভাবে কাজের অভিযোগে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় তিন হাজার বেশি।
এখানকার খবরের কাগজগুলোতে এখন প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও “ইমিগ্রেশন রেইড” বা “ওয়ার্কপ্লেস ইনস্পেকশন” শিরোনাম দেখা যায়। খাদ্য সরবরাহ, বিউটি সেলুন আর গাড়ি ধোয়ার মতো খাতগুলোতে এই অভিযান সবচেয়ে বেশি চলছে। অনেকেই বলে, এসব খাতেই অনিবন্ধিত শ্রমিকদের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি।
লেবার পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার এখন প্রবল চাপের মুখে। অভিবাসন নিয়ে জনমনে অসন্তোষ আছে, আর রিফর্ম ইউকে নামের পপুলিস্ট দল সেই ক্ষোভকে পুঁজি করছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী কিয়্যার স্টারমার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ এখন দেখাতে চান, তারা “আইনের শাসন” প্রতিষ্ঠায় কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। শাবানা মাহমুদ বলেছেন, অবৈধভাবে কাজ করার সুযোগই মানুষকে অবৈধ পথে ব্রিটেনে ঢোকার প্রলুব্ধতা দেয়। তার ভাষায়, “এখন আর তা চলবে না।”
তবে এখানে লন্ডনের কফিশপে, টিউব স্টেশনে, কিংবা রাস্তার মোড়ে অনেকেই ফিসফিসিয়ে বলছেন, এই অভিযান শুধু অবৈধ শ্রমিকদের নয়, বরং ভয়ের নতুন এক পরিবেশ তৈরি করছে। কেউ কেউ বলছেন, মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের মানুষ অযথাই সন্দেহের চোখে পড়ছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, সরকারের কড়াকড়ি হয়তো অভিবাসন সমস্যা কমাবে না, বরং সমাজে বিভাজন বাড়াবে।
স্টারমার সরকার অবশ্য তাদের অবস্থানে অনড়। তারা এখন এক ধাপ এগিয়ে ভাবছে ডিজিটাল পরিচয়পত্র চালুর বিষয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশে কাজ করতে চাইলে প্রত্যেকেরই একটি বাধ্যতামূলক ডিজিটাল আইডি থাকতে হবে। সরকারের ধারণা, এতে করে অবৈধভাবে কাজ করা বা নকল পরিচয়ে চাকরি পাওয়া বন্ধ হবে।
অন্যদিকে গিগ ইকোনমির ক্ষেত্রেও চলছে নতুন অভিযান। ডেলিভারি সার্ভিস প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন ডেলিভারু, ইট ও উবার ইটসকে সরকার নির্দেশ দিয়েছে, যেন তারা ড্রাইভারদের পরিচয় যাচাই আরও কড়াকড়ি করে। কারণ দেখা গেছে, অনেক সময় বৈধ ড্রাইভারের নামে অন্য কেউ তার একাউন্ট ব্যবহার করে কাজ করছে, যা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ।
গত জুলাইয়ে সরকার এই তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি ডেটা-শেয়ারিং চুক্তি করেছে, যার মাধ্যমে অবৈধভাবে কাজ করা বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা সহজ হবে। অভিবাসন কর্মকর্তারা বলছেন, এটি অবৈধ শ্রম ব্যবস্থার “ফাঁকফোকর বন্ধের” পথে একটি বড় পদক্ষেপ।
শীতের শুরুতে লন্ডনের আকাশ ধূসর হয়ে আসে, কুয়াশা নামতে থাকে টেমস নদীর ধারে। সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে প্রতিদিন শত শত শ্রমিক কাজের খোঁজে রওনা হয়। কেউ বৈধ কাগজে, কেউ অবৈধভাবে। কিন্তু এখন তারা জানে, প্রতিটি রাস্তার কোণে, প্রতিটি দোকানের ভেতরেই আছে নজরদারি। ব্রিটেনের এই নতুন বাস্তবতায় অনেকেরই নিশ্বাস যেন একটু ভারী হয়ে উঠেছে।










