বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কুষ্টিয়া: আধুনিক সভ্যতার ঝলমলে আড়ালের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে এক সময়ের প্রাণচঞ্চল গ্রামবাংলা। হারিয়ে যাচ্ছে বংশপরম্পরায় চলা লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সেই হারানো ধুলোমাটির গর্বিত অধ্যায়ের নাম লাঠি খেলা। একে কেবল খেলা বলা চলে না, এটি ছিল বাংলার গ্রামীণ জনপদের সাহস, শৃঙ্খলা আর আত্মরক্ষার এক জীবন্ত শিল্প।
লাঠি খেলা মানে ঢাক-ঢোলের তালে তালে গানের সঙ্গে ছন্দবদ্ধ লাঠির কসরত। মাঠজুড়ে যেন উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষের লাঠির আঘাত ঠেকিয়ে নিজের পাল্টা আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েন লাঠিয়ালরা। তাদের ভঙ্গিমা, চোখে আগুন, হাতে দৃঢ়তা—সব মিলিয়ে এটি এক জীবন্ত যুদ্ধনৃত্য। আর সেই নৃত্যকে ঘিরে মাঠের চারপাশে জড়ো হয় শত শত দর্শক, যারা ঢাক-ঢোল আর কাঁসার শব্দে মেতে ওঠে উল্লাসে। গানের তালে দর্শকের হাততালি ও গর্জনে খেলার উত্তাপ যেন আরও বাড়ে।
শিকড়ের গল্প
লাঠি খেলার সূচনা কবে, তা নিঃসন্দেহে বলা কঠিন। তবে এটি যে কৃষিভিত্তিক সমাজের আত্মরক্ষা ও সম্মান রক্ষার একটি কৌশল ছিল, তা বলা যায় নিঃসঙ্কোচে। জমিদার আমলে কিংবা দাঙ্গা প্রতিরোধে একদল লাঠিয়াল দল নিয়ে পাহারা দিত গ্রামের সম্পদ ও সম্মান। সেই বীরত্বের ধারা একসময় রূপ নেয় নান্দনিক খেলায়।
উৎসবে রূপ নেয় প্রতিযোগিতা
আজও দেশের কিছু অঞ্চলে মেলা কিংবা পার্বণে আয়োজন করা হয় লাঠি খেলার। ঢাক, ঢোল, কাঁসা আর শিঙার বেজে ওঠা শব্দে খেলা শুরু হয়। খোলা মাঠে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লাঠি চালনা করতে নামেন দুজন বা দলবদ্ধ লাঠিয়াল। চারপাশ থেকে দর্শকগণ উল্লাসে ভরিয়ে দেন মাঠ। অনেক সময় মেলার মূল আকর্ষণই হয়ে ওঠে এই খেলা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন এই লড়াই দেখতে। তারা কেবল খেলা দেখতে নয়, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ছুঁয়ে দেখতে, অনুভব করতে।
সময়ের স্রোতে বিলুপ্তির পথে
তবে দুঃখজনকভাবে এই ঐতিহ্যবাহী খেলা আজ বিলুপ্তির পথে। যান্ত্রিক জীবন, স্মার্টফোনে আসক্তি, আইনি জটিলতা ও স্থানীয় আগ্রহের অভাবে লাঠি খেলা হারাতে বসেছে তার ধারাবাহিকতা। আধুনিক শিক্ষায় এর স্থান না থাকলেও, এর ভেতরেই ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণ, সাহস, কৌশল ও সম্মিলন।
নতুন করে জাগাতে হবে ঐতিহ্য
এই প্রাচীন ক্রীড়াকে ফিরিয়ে আনতে চাই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা, চাই স্থানীয় প্রশাসন ও উৎসাহী নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ। লাঠি খেলার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, স্থানীয় প্রতিযোগিতা, বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে এই ঐতিহ্য আবার প্রাণ পেতে পারে।
শেষ কথা
লাঠি খেলা শুধুই অতীত নয়। এটি একান্তই আমাদের। এখন সময়, ইতিহাসকে মাটিতে ফেরানোর। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ আর বীরত্বের গল্প—সেই মাঠে আবার যেন বাজে ঢাক, নড়ে উঠে লাঠি আর জেগে ওঠে বাংলা।