বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনায় থাকা লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে পেয়েছে ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস। পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব) মডেলে প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে আধুনিক এই টার্মিনালটি নির্মাণ করবে প্রতিষ্ঠানটি। নকশা থেকে শুরু করে অপারেশন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি পরবর্তী ৩০ বছর এককভাবে পরিচালনা করবে এপিএম টার্মিনালস।
চুক্তি স্বাক্ষর: গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক
সোমবার (১৭ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) ও এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়। এপিএম টার্মিনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টেইন ভ্যান ডোঙ্গেন এবং সিপিএ চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দলিলে সই করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির (পিপিপিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক স্টেট সেক্রেটারি লিনা গ্যান্ডলোসে হ্যানসেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মোলার এবং বিশ্বখ্যাত মায়ের্কস গ্রুপের বোর্ড চেয়ারম্যান রবার্ট মার্স্ক উগলা।
অতিথিরা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য কাঠামোয় বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এমন সময় চট্টগ্রাম বন্দরে আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল নির্মাণ দেশের রপ্তানি সামর্থ্য ও লজিস্টিক নেটওয়ার্ককে আরও কার্যকর করবে।
প্রকল্পের কাঠামো ও বাস্তবায়ন সময়সীমা
সিপিএ সূত্র জানায়, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে অপারেশনে যেতে পারে ২০২৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে। নির্মাণ শেষ হলে প্রতিদিন আরও বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং, দ্রুত ডেলিভারি এবং জাহাজের অপেক্ষার সময় কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। এপিএম টার্মিনালস উন্নত ক্রেন, ডিজিটাল হ্যান্ডলিং সিস্টেম, অটোমেশন এবং আধুনিক সেফটি প্রটোকল যুক্ত করবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ধারণক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। শিল্পপতি ও রপ্তানিকারকেরা আশা করছেন, এটি বাংলাদেশের লজিস্টিক খরচ কমাবে এবং বাণিজ্য সহজীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
বিনিয়োগের গুরুত্ব: দেশীয় অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনা
বাংলাদেশে পিপিপি প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রটি এখনো সীমিত। সেই প্রেক্ষাপটে বিশ্বখ্যাত মায়ের্কস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালসের এ বিনিয়োগকে বড় ইতিবাচক বার্তা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক পোর্ট অপারেটরের অংশগ্রহণ বন্দর ব্যবস্থাপনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনবে এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ ও আধুনিক করে তুলবে।
অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য, সামুদ্রিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশের জন্য বড় আকারের অবকাঠামো উন্নয়ন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য জরুরি।
তবে কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ৩০ বছরের চুক্তি হলেও সার্বিক তদারকি, চার্জ-নীতিমালা, স্থানীয় কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং পরিবেশগত প্রভাব বিষয়গুলোতে সরকারের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। তাছাড়া নির্ধারিত সময়সীমায় প্রকল্প সম্পন্ন করা, নদী ও সমুদ্রপথের স্বাভাবিক প্রবাহ রক্ষা এবং আশপাশের বসবাসকারী মানুষের ওপর প্রভাবও বিবেচনায় রাখতে হবে।
এ ছাড়া লিজের দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো ভবিষ্যতে বন্দর ফি ও সার্ভিস চার্জের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণকে কতটুকু প্রভাবিত করতে পারে—সেটিও আলোচনায় রয়েছে।
সব মিলিয়ে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণ উদ্যোগগুলোর একটি হিসেবে নতুন অধ্যায় রচনা করতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ও দীর্ঘমেয়াদি অপারেশন-দায়িত্ব একসঙ্গে যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পটি দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে স্বচ্ছতা, সময়সীমা রক্ষা ও পরিবেশগত সুরক্ষা—এই তিনটি বিষয়ই হবে প্রকল্প সফলতার মূল চাবিকাঠি।










