লালনের দেশে : পর্ব ৯
মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: ছেঁউড়িয়ার পথে পা রাখলেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি ঘিরে ধরে। লালনের আখড়াবাড়ির মাটি যেন কথা বলে, প্রত্যেক ধুলিকণায় জেগে থাকে কোনো এক নিঃশব্দ মানবতা। এই শেষ পর্বে আমরা দেখে নেব একদিনের ছেঁউড়িয়ার জীবন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
সকালের আলো যখন ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে আখড়ার আঙিনায়, তখনই শুরু হয় বাউলদের দিনের কর্মযাত্রা। কিছু বাউল পত্র-পল্লব জড়ো করে আগুন জ্বালাচ্ছেন, কেউ কেউ গরম পানি তৈরি করছেন স্নানের জন্য। নারীরা কলসিতে পানি তুলছেন, আবার কেউ সকালের রুটি সেঁকছেন ছোট চুলায়। চারদিকে তখনও এক গভীর নীরবতা।
আখড়ার মূল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা লালনের সমাধির চারপাশে ধূপ, ফুল আর কিছু বাতাস রাখেন সেবায়েতরা। একপ্রকার স্বেচ্ছাশ্রমেই চলে এসব। সকাল আটটার দিকে শুরু হয় গানের ধ্যানপর্ব। ৫-৬ জন বাউল মিলিত হয়ে বসেন চট বা পাটপাতার চটাইয়ের উপর, একতারা, দোগি, খঞ্জনি হাতে তুলে নেন তারা।
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”—এই গানে শুরু হয় দিনের সাধনা। কেউ চোখ বন্ধ করে গান করছেন, কেউ তাল দিচ্ছেন কাঁধ দুলিয়ে। কোনোকিছুর তাড়াহুড়ো নেই, নেই মোবাইল ফোনের শব্দ, নেই শহুরে হট্টগোল। এই নিস্তব্ধতা যেন এক ধ্যানী জীবনের পরিচয়।
দুপুরের দিকে আখড়ার ভেতরে একটি ছোট রান্নাঘরে তৈরি হয় খিচুড়ি। যারা সাধনায় অংশ নেন, তাদের মধ্যেই এই খাদ্য ভাগ করে দেওয়া হয়। খাদ্যাভ্যাসও সরল—ডাল, শাক আর ভাত। কেউ কেউ দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেন, কেউ গানের বই খুলে গান অনুশীলন করেন, আবার কেউ এসে বসেন দর্শনার্থীদের সঙ্গে আলোচনায়।
বিকেলবেলা আখড়ায় আসেন কিছু পর্যটক বা দর্শনার্থী। কেউ আসেন লালনের কবর দেখতে, কেউ গান শুনতে। কেউ আবার নিজের অস্থিরতা লালনের শান্ত পরিবেশে রেখে যেতে চান। এই সময়টায় কিছু বাউল দর্শনার্থীদের অনুরোধে গান করেন। তবে তা কখনোই বিনিময়মূল্য ভিত্তিক নয়—গান এখানে দান, বাণিজ্য নয়।
সন্ধ্যার পর প্রদীপ জ্বলে ওঠে। বাতাসে ধূপের গন্ধ, দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির মৃদু সুর। এই সময়েও চলতে থাকে গান, কিন্তু তাতে থাকে একরকম বিষাদ—যেন দিনশেষের নিঃশব্দ বিদায়। এক বাউল গাইছেন, “এই দেহের মাঝে আছে রে এক অচিন মানুষ…” গানটি আখড়ার দেয়াল ছুঁয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে।
এইভাবেই ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় কেটে যায় একদিন—যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে লালনের চিন্তা, দর্শন ও মানবতা বেঁচে থাকে নিঃশব্দে, কিন্তু গভীরভাবে। কেউ এখানে আসে দর্শক হয়ে, কেউ বা পথিক, কেউবা খুঁজে ফেরে নিজের হারিয়ে যাওয়া ভেতরের মানুষটিকে।