Home বিনোদন কালের লালন: স্মৃতি, সংগ্রহ ও উত্তরাধিকার

কালের লালন: স্মৃতি, সংগ্রহ ও উত্তরাধিকার

লালনের দেশে : পর্ব ১০ ( শেষ )

মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: ফকির লালন শাহ আর নেই। কিন্তু তাঁর চিন্তা, গান ও জীবনদর্শন আজও বহমান। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উত্তরাধিকার আমরা কীভাবে ধারণ করছি? কী আছে লালনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে? কে রক্ষা করছে তাঁর গানের দলিল, দর্শনের মূলধারা? আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তাঁকে কীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে?

ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে আছে লালনের একটি সমাধিস্মারক, যেখানে নিয়মিত দর্শনার্থীরা ধূপধুনা দেন, ফুল দেন, গান গেয়ে শ্রদ্ধা জানান। তবে স্মারকের আশপাশে সেভাবে নেই কোনো পাঠকেন্দ্র, নেই স্থায়ী তথ্যবহুল প্রদর্শনী বা ইন্টার‍্যাকটিভ গাইড। পর্যটকরা অনেক সময়ই নিরুত্তর থাকেন—কে ছিলেন লালন, কী ছিল তাঁর দর্শন, তা বুঝে ওঠার মতো উপকরণ সেখানে কম।

লালনের গানের সংগ্রহ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। তাঁর গানের অধিকাংশ দলিলই মৌখিক, গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সংরক্ষিত। কেউ কেউ খাতায় লিখেছেন, কিন্তু সেই খাতা কতটা সঠিক বা কতটা প্রামাণ্য—তা নিশ্চিত করা কঠিন। কয়েকজন গবেষক ও সংগ্রাহক ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর গান সংকলন করেছেন, কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই বেসরকারি পর্যায়ে থেকে গেছে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলা একাডেমি লালনের ওপর কিছু প্রকাশনা করেছে। তবে ছাপা বইয়ের বাইরে ডিজিটাল সংগ্রহ গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ ‘লালন ডিজিটাল আর্কাইভ’ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যেখানে তাঁর গানের রেকর্ড, পাণ্ডুলিপি, প্রবন্ধ, নাট্যনাটক ও গবেষণালব্ধ দলিল থাকবে উন্মুক্তভাবে।

তবে আশার কথা, কিছু নতুন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। “লালন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ” নামের একটি দল কুষ্টিয়া ও ঢাকায় যৌথভাবে লালনের গান ও বক্তৃতা রেকর্ড করে অনলাইন আর্কাইভে আপলোড করার কাজ শুরু করেছে। “ভেতরের মানুষ” নামে একটি তরুণ সংগঠন লালনের গানের অডিও রূপ সংরক্ষণে কাজ করছে, যাতে বাউলদের মুখের গান হারিয়ে না যায়।

কিন্তু এইসব প্রচেষ্টা বিচ্ছিন্ন এবং নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালায় পরিচালিত নয়। আজ প্রয়োজন একটি জাতীয়ভিত্তিক সমন্বিত লালন আর্কাইভ, যেখানে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা, সংরক্ষণ ও চর্চা চলবে সমন্বয়ে। শুধু গান নয়—লালনের দর্শন, ভাষা, বোধ, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি যেন আগামী প্রজন্মের জন্য যথাযথভাবে তুলে ধরা যায়।

নতুন প্রজন্মের অনেকে লালনের গান শোনে ইউটিউবে, কেউ কেউ দেখে নাটকে কিংবা সিনেমায়। কিন্তু তারা যদি না জানে লালনের মূল দর্শন—“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”—তাহলে এই উত্তরাধিকার থেকে যাবে খণ্ডিত। তাই লালনের উত্তরাধিকার রক্ষার দায়িত্ব এখন কেবল গবেষক কিংবা বাউলের নয়—এটি এখন সমগ্র জাতির সাংস্কৃতিক দায়।

আজ যদি আমরা লালনের দলিল ও দর্শনকে ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম লালনকে পাবে শুধুই উৎসবে, গানে—তাঁর দর্শনের গভীরতা থেকে অনেক দূরে। এই সময়ে প্রয়োজন স্মৃতি, সংগ্রহ ও দর্শনের এক নিঃস্বার্থ সংরক্ষণযজ্ঞ।