বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কুমিল্লা: কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের হাওড়াতলী গ্রামে অবস্থিত লোকজ ঐতিহ্য জাদুঘর ইতিহাস ও সংস্কৃতির অমূল্য ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছেন এই অনন্য প্রতিষ্ঠান। শুরুটা হয়েছিল একটি ছোট পাঠাগার দিয়ে, আর আজ তা রূপ নিয়েছে দেশের অন্যতম বড় ব্যক্তিগত জাদুঘরে।
এখানে সংরক্ষিত আছে প্রায় বারো হাজার নিদর্শন, যার ভেতর রয়েছে গ্রামীণ জীবন, লোকসংস্কৃতি, কৃষিভিত্তিক সমাজ, সংগীত, সাহিত্য ও রাজনীতির অমূল্য উপাদান। প্রতিটি নিদর্শন কেবল জিনিসপত্র নয়, বরং একটি সময়ের ইতিহাস বহন করে।
সংগীত ও শিল্পের ভাণ্ডার
জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো দুর্লভ সংগীতসংগ্রহ। এখানে আছে ১৯২৭ সালের প্রাচীন গ্রামোফোন বা কলের গানের মেশিন এবং কয়েক শত দুর্লভ এলপি ক্যাসেট। সংরক্ষিত আছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কলেরগান রেকর্ড, গওহর জান, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আহমেদ রফি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম রেকর্ডসহ বহু কিংবদন্তি শিল্পীর অডিও স্মারক। এগুলো সংগীতের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ।
ইতিহাস ও সংগ্রহ
জাদুঘরে রয়েছে চার শত বছরের পুরোনো সিন্দুক, বারো শত বছরের পুরোনো কয়েন এবং বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের প্রায় তিন হাজার মূল্যবান মুদ্রা ও নোট। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশনের দুর্লভ স্মারক, যেটি ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। আছে দুই শত পঁচিশ বছর আগের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দলিলও।
সংরক্ষিত আছে দেড় শতাধিক দেশের পাঁচ হাজার প্রাচীন ডাকটিকিট। এগুলো ডাক ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দলিল হিসেবে মূল্যবান।
কৃষি ও গ্রামীণ ঐতিহ্য
প্রাচীন বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে ব্যবহৃত তিন থেকে চার শতাধিক কৃষিযন্ত্র এখানে প্রদর্শিত। হাল-লাঙল, ঢেঁকি, ধান ভাঙার বিভিন্ন উপকরণ, মাছ ধরার যন্ত্র থেকে শুরু করে তাঁতের সরঞ্জাম—সব মিলিয়ে এগুলো একসময়ের গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
লোকজ ঐতিহ্য জাদুঘরে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও সংরক্ষিত আছে। এখানে আছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত আর্টিলারি শেল, বুলেট, বন্দুক এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে রিলিফ হিসেবে আনা সাত কোটি কম্বলের একটি কম্বল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানা ঘটনার প্রায় পাঁচ হাজার আলোকচিত্র ও উপকরণ সংরক্ষিত রয়েছে।
জাদুঘরে রাখা হয়েছে প্রাচীন টাইপরাইটার, ঘড়ি, কাঠের বক্স টেলিভিশন, রেডিও, ভিসিআর, নানা মডেলের ক্যামেরা ও ভিডিও রেকর্ডার, পুরোনো টেলিফোন, সিনেমা হলে ব্যবহৃত রিল ক্যাসেট এবং বিভিন্ন সময়ের অডিও-ভিডিও ক্যাসেট। সংরক্ষিত আছে প্রাথমিক মডেলের মোবাইল ফোনও।
এছাড়া রয়েছে প্রাচীন কলম, দোয়াত, বিখ্যাত সুলেখা কালি, শৈশবের খেলার উপকরণ, প্রাচীন কুপি, হারিকেন, টর্চলাইট, খড়ম, চরকা, বাদ্যযন্ত্র এবং হারিয়ে যাওয়া প্রসাধন সামগ্রী।
প্রকৃতির নিদর্শন
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশের ৩২০টি নদীর পানি ও মাটির সংগ্রহ এবং ৬৪ জেলার মাটি। এগুলো শুধু প্রদর্শনী নয়, বরং বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশের জীবন্ত দলিল।
লোকজ ঐতিহ্য জাদুঘর শুধু একটি প্রদর্শনীকেন্দ্র নয়, বরং এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগীত, কৃষি ও সমাজজীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে। যারা শেকড়ের সন্ধান করতে চান, তাদের জন্য এই জাদুঘর এক অপরিহার্য গন্তব্য। শিক্ষার্থী, গবেষক, ইতিহাসবিদ এবং সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে এটি বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক সম্পদ।
জাদুঘরে উৎসুক কচিকাঁচারা। ছবি সংগৃহীত