নিষিদ্ধ প্লাস্টিক পোস্টার
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: নির্বাচনের সময় শহরজুড়ে মাইকের অসহনীয় শব্দ, শোডাউনের কারণে তীব্র যানজট, আর প্লাস্টিক মোড়ানো পোস্টারে পরিবেশ দূষণ—এই চিরাচরিত নির্বাচনী চিত্রে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫’-এ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এবং পরিবেশ রক্ষায় নজিরবিহীন সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
গেজেটভুক্ত নতুন এই বিধিমালায় জনদুর্ভোগ রোধ ও পরিবেশবান্ধব প্রচারণার লক্ষ্যে যেসব কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার মূল বিষয়গুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
১. শোডাউন ও মোটরবাইক মিছিল পুরোপুরি নিষিদ্ধ
নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাস্তা আটকে বিশাল মিছিল বা মোটরসাইকেলের মহড়া জনজীবনের জন্য সবচেয়ে বড় ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিধিমালার ৯ নম্বর বিধিতে এই সংস্কৃতি বন্ধে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যানবাহন ব্যবহারে মানা: বিধি ৯(ক) ও ৯(খ) অনুযায়ী, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো বাস, ট্রাক, নৌযান, মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো যান্ত্রিক বাহন ব্যবহার করে কোনো মিছিল বা শোডাউন করা যাবে না।
মনোনয়ন দাখিলে ভিড় নয়: মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় প্রার্থীরা বিশাল বহর নিয়ে যান, যা অফিস পাড়ায় যানজট সৃষ্টি করে। এবার বিধি ৯(ঘ) অনুযায়ী, রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থীর সাথে ৫ (পাঁচ) জনের বেশি লোক প্রবেশ করতে পারবেন না।
২. প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত প্রচারণা
পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে এবারই প্রথম নির্বাচনী পোস্টারে প্লাস্টিকের ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ল্যামিনেটেড পোস্টার নিষিদ্ধ: বিধিমালার ৭(খ) বিধি অনুযায়ী, পচনশীল নয় এমন দ্রব্য—যেমন রেক্সিন, পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করা যাবে না। বিশেষ করে পোস্টার বা প্রচারপত্রে পলিথিনের আবরণ (Laminated Poster) বা প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
দেওয়াল লিখন বন্ধ: শহরের সৌন্দর্য রক্ষায় ১১ নম্বর বিধি অনুযায়ী, কোনো দেওয়াল, দালান, বেড়া বা গাছে সরাসরি কালি দিয়ে লেখা বা আঁকা যাবে না। পোস্টার বা ব্যানার ঝোলাতে হবে, আঠা দিয়ে লাগানো যাবে না।
৩. শব্দদূষণ রোধে সময় ও মাত্রার সীমা
শিক্ষার্থী, অসুস্থ রোগী ও বয়স্কদের কথা বিবেচনা করে মাইক ব্যবহারের ওপর কঠোর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
সময়সীমা: ১৭(২) বিধি অনুযায়ী, দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত—কেবল এই ৬ ঘণ্টাই মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা যাবে। এর আগে বা পরে প্রচার চালানো দণ্ডনীয় অপরাধ।
শব্দমাত্রা: ১৭(৩) বিধি অনুযায়ী, প্রচারকাজে ব্যবহৃত মাইক বা সাউন্ড সিস্টেমের শব্দের মাত্রা কোনোভাবেই ৬০ (ষাট) ডেসিবলের বেশি হতে পারবে না।
৪. চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না
রাস্তা দখল করে জনসভা বা ক্যাম্প স্থাপন করা যাবে না।
রাস্তা অবরোধ: ৬(ঙ) বিধি অনুযায়ী, জনগণের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন কোনো সড়ক বা মহাসড়কে জনসভা বা পথসভা করা যাবে না।
তোরণ নির্মাণ: ১৩ বিধি অনুযায়ী, চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন কোনো গেট বা তোরণ নির্মাণ করা যাবে না। প্যান্ডেল বানালেও তা ৪০০ বর্গফুটের বেশি হতে পারবে না।
৫. ক্যাম্প স্থাপনে বিধিনিষেধ
যত্রতত্র নির্বাচনী ক্যাম্প বসিয়ে আড্ডা ও শব্দদূষণ রোধে ১৩(ঘ) ও ১৩(ঙ) বিধি কার্যকর করা হয়েছে।
কোনো সড়ক বা জনগণের চলাচলের সাধারণ স্থানে নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করা যাবে না।
ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রতিটি দলের জন্য মাত্র একটি নির্বাচনী ক্যাম্প বা অফিস থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একাধিক অফিস স্থাপন দণ্ডনীয়।
শাস্তি ও পরিণতি
জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করলে বা পরিবেশ দূষণ করলে প্রার্থীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ২৭ বিধি অনুযায়ী, এই নিয়মগুলো ভাঙলে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে। এমনকি ২৮ বিধি অনুযায়ী, অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন ওই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।
অতীতের নির্বাচনগুলোতে আচরণ বিধি থাকলেও তা প্রয়োগে শিথিলতা দেখা যেত। তবে ২০২৫ সালের বিধিমালার ভাষা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং পরিবেশবান্ধব। বিশেষ করে প্লাস্টিক ল্যামিনেশন নিষিদ্ধকরণ এবং শোডাউন বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তা বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক ও আধুনিক অধ্যায় যোগ করবে। এখন দেখার বিষয়, মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ এই জনবান্ধব বিধিগুলো কতটা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে।










