বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ন দীর্ঘদিন ধরে শব্দদূষণকে একটি জটিল এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ সমস্যায় পরিণত করেছে। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী থেকে শুরু করে দ্বিতীয় সারির শহরগুলোতে যানবাহনের হর্ণ, নির্মাণকাজের শব্দ, কারখানার যন্ত্র, উৎসব-অনুষ্ঠানের উচ্চস্বরের সাউন্ড সিস্টেম এবং রাজনৈতিক সমাবেশ মিলিয়ে শব্দের চাপ এক ধরনের ক্রমাগত পরিবেশগত সংকট সৃষ্টি করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী দীর্ঘ সময় উচ্চমাত্রার শব্দে বসবাস করলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি, ঘুমের ব্যাঘাত, হৃদরোগের ঝুঁকি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, কর্মস্থলে মনোযোগ কমে যাওয়া এবং শিশুদের শেখার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার মতো ক্ষতি হয়। বাংলাদেশেও এসব প্রভাব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। শহুরে মানুষ অভিযোগ করে যে রাতে যথেষ্ট ঘুম হয় না, প্রতিনিয়ত শব্দের কারণে মাথাব্যথা থাকে এবং দিনের কাজকর্মে মনোযোগ ব্যাহত হয়।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে আগের আইনগুলো ছিল অনেকটাই অপর্যাপ্ত। বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ সংক্রান্ত নির্দেশনা থাকলেও শব্দদূষণের ক্ষেত্রে কঠোর প্রয়োগ ও নির্ভরযোগ্য মনিটরিংয়ের অভাবে বাস্তব সুফল পাওয়া যায়নি। বিগত কয়েক বছর ধরে পরিবেশবিদ, চিকিৎসক ও নগর পরিকল্পনাবিদরা শব্দদূষণকে জনস্বাস্থ্য সংকট ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের মতে, বিষয়টি শুধু পরিবেশ দূষণের সমস্যা নয়, বরং মানুষের জীবনমান, শিক্ষার পরিবেশ এবং মানসিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
এই পটভূমিতে সরকার ২০২৫ সালে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা জারি করে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এর মাধ্যমে ২৩ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং ২৪ নভেম্বর এটি বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়। বিধিমালায় শব্দসীমা নির্ধারণ থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগে শক্তিশালী ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নাগরিক অভিযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, এবং অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোর জরিমানার মতো বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
শহরগুলোর শব্দমাত্রা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের উপরও প্রভাব ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কর্মীরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও মানসিক শান্তি না পেলে উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য খরচ বেড়ে যায়। বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষাজীবনে শব্দদূষণ বড় বাধা। পরীক্ষার সময় বা ক্লাস চলাকালীন বাইরে থেকে আসা শব্দ তাদের মনোযোগ নষ্ট করে এবং শেখার ধারা ব্যাহত করে।
সামাজিক প্রেক্ষাপটেও শব্দদূষণ একটি অব্যাহত বিরক্তির উৎস হয়ে উঠেছে। অনেকেই অভিযোগ করেন রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক আয়োজনে ডিজে সাউন্ড, রাজনৈতিক মাইকিং বা নির্মাণকাজের কারণে শান্তিতে ঘুমানো যায় না। এসব অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরেই সরকারকে কঠোর বিধিমালা তৈরির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। নতুন বিধিমালা তাই শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং জনস্বাস্থ্য রক্ষার জরুরি উদ্যোগ হিসেবে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায় এবং নাগরিকরা সচেতন হন, তবে শহরগুলোতে শব্দের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে এবং মানুষ একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল নগরজীবন উপভোগ করতে পারবে।