Home চট্টগ্রাম বন্দরের বাড়তি শুল্ক পুনর্বহাল: উন্নয়ন বনাম মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি

বন্দরের বাড়তি শুল্ক পুনর্বহাল: উন্নয়ন বনাম মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ উঠে যাওয়ার পরপরই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) কর্তৃক বাড়তি শুল্কহার পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের ব্যয় কাঠামোতে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একদিকে যেমন বন্দর কর্তৃপক্ষ অবকাঠামো আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই রাজস্ব বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে, অন্যদিকে তেমনি ব্যবসায়ীরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে এই অতিরিক্ত চার্জ শেষ পর্যন্ত পণ্যমূল্যে যোগ হয়ে বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়াবে।

এই সিদ্ধান্ত কেবল বন্দরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, বরং দেশের সামগ্রিক লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা, পণ্যের দাম এবং ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার সক্ষমতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা।

বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌক্তিকতা: সক্ষমতা বৃদ্ধির অপরিহার্যতা

সিপিএ এই বর্ধিত শুল্কহার পুনর্বহালের পক্ষে যুক্তি দিয়েছে যে, বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে বন্দরের আধুনিকীকরণ অত্যাবশ্যক। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য চাহিদা এবং জাহাজের চলাচল বৃদ্ধির সঙ্গে বন্দরের বর্তমান সুবিধা ও ক্ষমতার ওপর চাপ বাড়ছে। কর্তৃপক্ষের মতে, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা, নিরাপত্তা জোরদার করা এবং প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের জন্য বিশাল অঙ্কের বাড়তি আয়ের প্রয়োজন।

দীর্ঘদিন ধরে শুল্কহার অপরিবর্তিত থাকার ফলে সৃষ্ট রাজস্ব ঘাটতি এবং বর্তমান অবকাঠামো সম্প্রসারণের লক্ষ্য পূরণে এই চার্জ সমন্বয়কে তারা অনিবার্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। যদি এই রাজস্ব সঠিকভাবে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে ব্যয় করা যায়, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।

ব্যবসায়ীদের শঙ্কা: লজিস্টিক ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির চাপ

শিপিং এজেন্ট, আমদানিকারক ও লজিস্টিক অপারেটরদের মূল উদ্বেগ হলো, এই বাড়তি চার্জের সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের লজিস্টিক ব্যয়ের ওপর। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ এবং পোর্ট সার্ভিস চার্জ বেড়ে গেলে তা পণ্যের মোট আমদানি ব্যয়কে অনিবার্যভাবে বাড়িয়ে দেবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ব্যবসায়ীরা সাধারণত এই অতিরিক্ত খরচ নিজে বহন না করে তা শেষ পর্যন্ত পণ্যের চূড়ান্ত মূল্যের সঙ্গে যোগ করে দেন। যেহেতু বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ সমুদ্রবাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরনির্ভর, তাই এই বর্ধিত ব্যয় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে পারে—বিশেষত খাদ্যপণ্য ও শিল্প কারখানার কাঁচামালের ক্ষেত্রে।

এছাড়াও, বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন নানা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন স্থানীয় পর্যায়ে লজিস্টিক খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নীতিগত স্থিতিশীলতার প্রশ্ন ও ঝুঁকি

আইনি জটিলতা কাটিয়ে শুল্কহার কার্যকর হলেও, ব্যবসায়িক মহলে নীতিগত স্থিতিশীলতা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। নতুন শুল্কহার ঘোষণার পর বারবার পরিবর্তন বা স্থগিতাদেশের ফলে বিনিয়োগকারী এবং আমদানিকারকদের মধ্যে এক ধরনের ঝুঁকি ও দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী আমদানি ও বিনিয়োগ পরিকল্পনার জন্য বন্দরের চার্জ-কাঠামোর একটি স্থিতিশীল এবং পূর্বাভাসযোগ্য পরিবেশ অপরিহার্য। নীতিগত অস্থিরতা সাময়িক রাজস্ব বৃদ্ধির চেয়ে সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য বেশি ক্ষতিকর হতে পারে।

বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের পূর্বাভাস

শুল্ক পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিকে এখন একটি দ্বি-মুখী পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

১. উন্নয়নের পথ: যদি সিপিএ এই বাড়তি রাজস্ব স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে অবকাঠামো আধুনিকীকরণ, যেমন নতুন ইয়ার্ড নির্মাণ, উন্নত যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং নাব্যতার উন্নয়ন এ ব্যবহার করতে পারে, তবে বন্দরের দক্ষতা বাড়বে। ফলে জাহাজের অপেক্ষার সময় কমবে এবং দ্রুত পণ্য খালাস হবে, যা লজিস্টিক ব্যয় বৃদ্ধিতে কিছুটা ভারসাম্য আনতে পারে।
২. বাজারের পথ: যদি রাজস্ব ব্যয়ে দক্ষতা না থাকে এবং ব্যবসায়ীরা কেবল খরচ বৃদ্ধির চাপ অনুভব করেন, তবে বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং ভোক্তাদের ওপর অর্থনৈতিক বোঝা চাপবে।

সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে স্বচ্ছ আলোচনা, বন্দরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ব্যবসায়ীদের অংশীদারিত্ব এবং নতুন শুল্কের সঠিক প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করছে এর চূড়ান্ত প্রভাব। এই পদক্ষেপ রাজস্ব বৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণের মাধ্যমে সমুদ্রবাণিজ্যকে শক্তিশালী করবে, নাকি কেবল মূল্যস্ফীতির নতুন একটি চাপ তৈরি করবে—তা জানতে এখন পর্যবেক্ষণে রয়েছে দেশের অর্থনীতি।