বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: এক সময়ের স্থবিরতায় আচ্ছন্ন দেশের শেয়ারবাজারে কি নতুন সম্ভাবনার আলো দেখা যাচ্ছে? দীর্ঘ এক বছরের টানা দরপতনের পর গত এক মাসে দেশের শেয়ারবাজারে যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা দিয়েছে, তাতে অনেক বিনিয়োগকারীর মনেই জেগেছে নতুন আশার সঞ্চার। তবে এই উত্থান কি দীর্ঘস্থায়ী হবে, নাকি আবারও অস্থিরতার ফাঁদে পড়বে বাজার—এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্র জানায়, গত ২৯ মে থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত ৩৬০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ২৯৩টির শেয়ারদর বেড়েছে। এর মধ্যে ৮৮টি কোম্পানির শেয়ার অন্তত ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ এরাই গত ১১ মাসে ৮ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছিল। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত শেয়ারগুলোর একটি বড় অংশই আংশিক ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে।
এই সময়ের মধ্যে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে প্রায় ২৭৮ পয়েন্ট, যা প্রায় ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। ১৯টি কার্যদিবসের মধ্যে সূচক বেড়েছে ১৪ দিনে, কমেছে মাত্র ৫ দিনে। পাশাপাশি বাজারের দৈনিক লেনদেনের পরিমাণও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে—২৯ মে যেখানে ২৪৭ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল, সেখানে ৩ জুলাই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৬ কোটি টাকায়।
পেছনের ঝড়: পতনের গল্প
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রথম দিকে বাজারে স্বস্তির আবহ তৈরি হলেও অল্প সময়েই সেই ঊর্ধ্বমুখী ধারা থমকে যায়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধাবস্থা ও ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য শুল্ক, ঘন ঘন সুদহার বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ভাটার টান পড়ে। বিশেষ করে সুদহার বৃদ্ধির ফলে বড় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকে পড়েন সঞ্চয়পত্র ও সরকারি বন্ডে। তারল্য সংকটে পড়ে বাজার, সৃষ্টি হয় আস্থার সংকট।
ফলে ১২ আগস্ট থেকে ২৮ মে পর্যন্ত মাত্র ১১৬ কার্যদিবসে বাজার সূচক হারায় ৩৭০১ পয়েন্ট। ৩৬০ কোম্পানির মধ্যে ৩৪১টির শেয়ারদর কমে যায়। ৩০৫টি কোম্পানি ২০ থেকে ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত দর হারায়। এই ভয়াবহ ধসের পর সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বগতি অনেকটা মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছে বাজারে।
আশার আলো: কী বদলেছে?
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাজারের গতিপথ ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ হলো রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবাহ, রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীল বিনিময় হার এবং সামষ্টিক অর্থনীতির কিছুটা স্থিতি ফিরে পাওয়া। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আশায় একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।
ডিএসই ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে এনেছে। অনেকে মনে করছেন, এখন যাই হোক, একটি স্থিতিশীল সরকার গঠিত হবে—এটা বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই ধারা স্থায়ী হবে কিনা, বলা যাচ্ছে না। বিনিয়োগযোগ্য ভালো শেয়ার সংখ্যা খুবই সীমিত। বাজারে যদি অতিরিক্ত বিনিয়োগ ঢুকে পড়ে, তবে বাবল তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।”
কোন খাত এগিয়ে?
গত এক মাসে সবচেয়ে বেশি উত্থান দেখা গেছে বস্ত্র, খাদ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং ব্যাংক খাতে। খাদ্য খাতের ২৩ কোম্পানির গড়ে পৌনে ১২ শতাংশ দর বেড়েছে। বস্ত্র খাতে ৫৮টির মধ্যে ৪২টির দাম বেড়েছে এবং গড় বৃদ্ধি ১১ শতাংশ। ব্যাংক খাতেও গড়ে ৮ শতাংশ বৃদ্ধির রেকর্ড মিলেছে।
একক কোম্পানি হিসেবে দেশ গার্মেন্টসের শেয়ার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এক মাসে, যদিও কোম্পানিটি গত বছর মাত্র ৩ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এ ছাড়া যেসব কোম্পানির দর ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে ইন্দোবাংলা ফার্মা, ইয়াকিন পলিমার, সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ব্যাংক, রহিমা ফুড, মেঘনা পেট ও লিগ্যাসি ফুটওয়্যার। অনেকের মতে, এসব কোম্পানির মৌলভিত্তি দুর্বল, ফলে এই উত্থান হয়তো অস্বাভাবিক।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
বাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে দরকার নতুন ও শক্ত ভিত্তির শেয়ার। নতুন আইপিও না থাকায় বাজারে ভালো কোম্পানির ঘাটতি প্রকট। বাজারে টেকসই উন্নতি নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া দরকার এমন অভিমত দিয়েছেন ব্রোকাররা।
শেয়ারবাজারের সামনে এখন দুই পথ- একদিকে বাস্তব ভিত্তির পুনর্গঠন, অন্যদিকে অতীতের মতো নতুন আরেকটি ফাঁপা বাবলের ফাঁদ। কোন দিকে যাবে বাজার, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।