Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য শেরে বাংলার শিকড়: বরিশালের জন্মভূমি ও পারিবারিক পটভূমি

শেরে বাংলার শিকড়: বরিশালের জন্মভূমি ও পারিবারিক পটভূমি

ছবি এ আই

শেরে বাংলা ও বরিশাল: ইতিহাসের আলেখ্য: পর্ব-১

অরূপ তালুকদার: 
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হক এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। কৃষকের বন্ধু, শিক্ষার অগ্রদূত এবং জননেতা হিসেবে তিনি সর্বত্র পরিচিত হলেও তাঁর জন্মভূমি বরিশাল ও পারিবারিক শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কের গল্পটি আলাদা আবেগ বহন করে। রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি ছিল, তার মূল পাওয়া যায় এই বরিশালের মাটিতেই।

১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালের সাতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবুল কাশেম ফজলুল হক। তাঁর পিতা ক্বারী ওয়াজেদ আলী ছিলেন একজন খ্যাতিমান আইনজীবী এবং মা সাইদা খাতুন ছিলেন ধার্মিক, সহৃদয়ী ও শিক্ষানুরাগী নারী। পরিবারটি ছিল সামাজিকভাবে সম্মানিত এবং শিক্ষার প্রচারে সক্রিয়। গ্রামীণ সমাজে শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে তাঁদের আন্তরিকতা পরবর্তী সময়ে ফজলুল হকের রাজনৈতিক দর্শনে গভীর ছাপ ফেলে।

শৈশবে বরিশালের প্রকৃতি, নদী-খাল এবং কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রা তাঁর মনে গ্রামীণ বাংলার প্রতি এক অটুট টান সৃষ্টি করে। যদিও পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পাড়ি জমাতে হয়, তবুও বরিশালের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে আজীবন ভাবিয়ে তুলেছিল। কৃষক সমাজের অর্থনৈতিক কষ্ট, ঋণের বোঝা আর জমিদারি শোষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে সাধারণ মানুষের নেতা হওয়ার প্রেরণা দেয়।

ইতিহাসবিদদের মতে, ফজলুল হকের পরিবার কেবল সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ছিল না, বরং মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ ছিল। তাঁর পিতা ওয়াজেদ আলী আইনপেশায় সৎ ও নির্লোভ ছিলেন, যা ছোট ফজলুল হককে ন্যায়বিচার ও সাহসিকতার শিক্ষা দেয়। অন্যদিকে মায়ের ধর্মনিষ্ঠা ও সমাজসেবামূলক কাজ তাঁর মধ্যে সহমর্মিতা ও দানশীলতার বীজ বপন করে।

বরিশালের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশও তাঁকে আলাদা মাত্রা দেয়। প্রাথমিক শিক্ষা এখানেই শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও আইন পড়াশোনায় তিনি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেন। কিন্তু বরিশালের প্রভাব কখনও তাঁর চরিত্র ও মানসিকতায় মুছে যায়নি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বরিশালের গ্রামীণ শেকড় না থাকলে হয়তো তিনি এতটা কৃষকবান্ধব ও সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারতেন না।

শেরে বাংলার রাজনৈতিক জীবনের সাফল্য যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃত, তেমনি তাঁর জন্মভূমি বরিশাল তাঁকে দিয়েছে দৃঢ় ভিত্তি। এখানকার অভিজ্ঞতা তাঁকে কৃষকের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে, শিক্ষা বিস্তারে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতাকে সামনে আনতে সাহায্য করেছে।

আজও বরিশালের মানুষ গর্ব করে বলেন— “শেরে বাংলার জন্ম আমাদের মাটিতে, আমাদের সমাজেই।” স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্মারক ও গবেষণা কার্যক্রম প্রমাণ করে যে বরিশালবাসীর কাছে তিনি শুধু একজন নেতা নন, বরং একজন পরিবারের সদস্য, যাঁর শিকড় আজও এই মাটির সঙ্গেই যুক্ত।

(চলবে)