অরূপ তালুকদার, বরিশাল: বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৩৭ সাল ছিল এক মোড় পরিবর্তনের বছর। সেই বছরের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হক বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (প্রিমিয়ার) নির্বাচিত হন। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবনের নয়, বরং সমগ্র বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল। বরিশালের মানুষ এই সাফল্যকে নিজেদের জয় বলে মনে করেছিলেন, কারণ শেরে বাংলা তাঁদেরই সন্তান, যাঁর সংগ্রামের মূল শেকড় ছিল এই মাটিতেই।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কংগ্রেস। তখন বাংলার রাজনীতিতে জমিদার ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রভাব ছিল প্রবল। কিন্তু ফজলুল হক ছিলেন কৃষক-শ্রমিকের প্রতিনিধি। তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই বিস্তৃত হয়েছিল যে, নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ফলে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রথমবারের মতো প্রকৃত অর্থে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর হাতে যায়।
ক্ষমতায় এসেই শেরে বাংলা কৃষকদের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। তিনি দেনার দায়ে জর্জরিত কৃষকদের মুক্তির জন্য Debt Settlement Board কার্যকর করেন, যা বাংলার কৃষক সমাজে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দেয়। জমিদারদের খাজনা আদায়ের প্রথা সীমিত করা, শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার আনা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ ছিল তাঁর শাসনের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
বরিশালের মানুষ বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিলেন তাঁর শাসনকাল থেকে। স্থানীয় কৃষকদের খাজনা কমানো, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং নদী তীরবর্তী এলাকার উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ তাঁকে বরিশালের মানুষের কাছে আরও প্রিয় করে তোলে। সমসাময়িক সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, বরিশালের গ্রামে গ্রামে তাঁর নাম উচ্চারণ করা হতো আশার প্রতীক হিসেবে।
তবে তাঁর শাসনকাল সহজ ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন এবং জমিদার শ্রেণি তাঁর কৃষকবান্ধব নীতির বিরোধিতা করে। বিরোধীদের নানা বাধা অতিক্রম করেও তিনি সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ চালিয়ে যান। এজন্য তাঁকে সমালোচনা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তবুও বাংলার মানুষ তাঁকে সমর্থন দিয়ে গেছেন নিরলসভাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেরে বাংলার ১৯৩৭ সালের শাসন বাংলার রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তি স্থাপন করে। কারণ এর আগে রাজনীতি মূলত অভিজাত ও শহরকেন্দ্রিক ছিল, কিন্তু তাঁর মাধ্যমে কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রথমবার ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছায়।
বরিশালের জনগণ আজও স্মরণ করেন সেই দিনগুলোকে, যখন তাঁদেরই সন্তান বাংলার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। স্থানীয় প্রবীণদের ভাষায়—“শেরে বাংলার সেই শাসন ছিল কৃষকের মুক্তির দিশারী।”
ফজলুল হকের শাসন প্রমাণ করে, প্রকৃত নেতৃত্ব তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন তা জনগণের দুঃখ-কষ্টের প্রতিফলন ঘটায়। তাঁর প্রিমিয়ারশিপ শুধু বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের নয়, বরং বরিশালের মানুষের হৃদয়ে এক অমলিন অধ্যায় হয়ে আছে।
(চলবে)










