Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য কৃষকপ্রেমী নেতা: ফজলুল হকের কৃষক নীতি ও বরিশালের কৃষক সমাজ

কৃষকপ্রেমী নেতা: ফজলুল হকের কৃষক নীতি ও বরিশালের কৃষক সমাজ

ছবি এ আই

শেরে বাংলা ও বরিশাল: ইতিহাসের আলেখ্য: পর্ব-৩

অরূপ তালুকদার: 

শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হক শুধু একজন আইনজীবী বা রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি বাংলার কৃষকসমাজের প্রকৃত বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। কৃষিনির্ভর বাংলার অর্থনীতি ও সমাজকে কেন্দ্র করে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ ঘটে। বিশেষ করে বরিশালের কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট ও জমিদারি শোষণ প্রত্যক্ষ করে তিনি তাঁদের জন্য সুদূরপ্রসারী নীতি প্রণয়ন করেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলার গ্রামীণ চিত্র ছিল ভয়াবহ। অধিকাংশ কৃষক চাষাবাদের পাশাপাশি ঋণের বোঝা বইছিলেন। জমিদারদের খাজনা, মহাজনের সুদখোরি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁদের জীবন প্রায় অচল হয়ে পড়ত। ফজলুল হক ছোটবেলা থেকেই বরিশালে এই বাস্তবতা দেখেছেন। তাই যখন তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, কৃষকের মুক্তি তাঁর আন্দোলনের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়ে তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি কৃষকদের জন্য একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল “Debt Settlement Board” গঠন। এই বোর্ডের মাধ্যমে কৃষকদের পুরনো ঋণের দায়মুক্তি দেওয়া হয়, ফলে তাঁরা সুদের ফাঁদ থেকে অনেকটাই মুক্তি পান। ইতিহাসবিদরা একে বাংলার কৃষক সমাজের জন্য এক বড় জয় বলে উল্লেখ করেছেন।

এ ছাড়া তিনি কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামীণ সমবায় সংগঠন গঠনে উৎসাহ দেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কৃষিকে শুধু জীবিকার উৎস না বানিয়ে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানো।

বরিশালের কৃষকরা এ কারণে তাঁকে নিজেদের অভিভাবক মনে করতেন। স্থানীয় কৃষকদের স্মৃতিচারণে জানা যায়, শেরে বাংলা মাঠে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাঁদের সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করতেন। শুধু আইন বা বিধান তৈরি করেই তিনি থেমে থাকেননি; বরং প্রত্যক্ষভাবে কৃষকদের জীবনের উন্নয়ন দেখতে চাইতেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, শেরে বাংলার কৃষকবান্ধব নীতি তাঁকে বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য নেতায় পরিণত করেছে। জমিদার ও মহাজনের প্রভাব যেখানে কৃষকের ঘাড়ে চেপে বসেছিল, সেখানে তিনি কৃষকের পক্ষে দাঁড়িয়ে শোষণমুক্তির সংগ্রামকে গতিশীল করেন। এর ফলে বাংলার কৃষক সমাজে এক নতুন চেতনার জন্ম হয়।

আজকের প্রেক্ষাপটে কৃষি এখনও বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। তাই শেরে বাংলার কৃষকবান্ধব নীতির গুরুত্ব এখনো কমেনি। বরিশালের মাঠ-ঘাটে তাঁর নাম উচ্চারণ করলে কৃষকেরা আজও গর্বের সঙ্গে বলেন—“তিনি ছিলেন আমাদের সত্যিকারের বন্ধু।”

শেরে বাংলা শুধু বরিশালের নয়, সমগ্র বাংলার কৃষকের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর এই কৃষকপ্রেমই তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে আজও অম্লান ও চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।

(চলবে)