সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা আজ শুধু পরিসংখ্যানের একটি দুঃখজনক তালিকা নয়, বরং এক গভীর সামাজিক সংকট। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেলজনিত দুর্ঘটনা। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৩৮ শতাংশই মোটরসাইকেল আরোহী যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এটি নিছক একটি দুর্ঘটনাজনিত ইস্যু নয়, বরং সড়ক ব্যবস্থাপনা, আইন প্রয়োগ ও সামাজিক উদাসীনতার সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
গত এক দশকে দেশে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ, অথচ সেই অনুপাতে প্রশিক্ষিত চালক তৈরি হয়নি, তৈরি হয়নি আলাদা লেন, নিরাপদ সিগন্যাল ব্যবস্থা কিংবা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের আধুনিক প্রযুক্তি। সড়কে মোটরসাইকেলের আধিপত্য এখন এতটাই ভয়ংকর যে প্রতিদিন অসংখ্য প্রাণ হারাচ্ছে, পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে, অথচ প্রতিকার নিয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ চালকই প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাস্তায় নামছেন। রাইড শেয়ারিং অ্যাপের কল্যাণে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অনভিজ্ঞ চালকদের উপস্থিতি আরও বেড়েছে। হেলমেটবিহীন চালক, যাত্রী বহন ও ফিটনেসবিহীন মোটরসাইকেল—সব মিলে পরিস্থিতি দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো দেশে আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি এবং বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশে আমরা কেন পারছি না? কারণ, এখানে এখনো চালকদের লাইসেন্স যাচাই হয় না নিয়মিতভাবে, ট্রাফিক পুলিশদের হাতে নেই আধুনিক প্রযুক্তি, আর আইনের প্রয়োগ প্রায় নিষ্ক্রিয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামী পাঁচ বছরে দুর্ঘটনার হার দ্বিগুণ হতে পারে। এই সতর্কবার্তা আমাদের উদাসীন সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় ধাক্কা হওয়া উচিত।
অতএব, এখনই সময় মোটরসাইকেল ব্যবহারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন, বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স যাচাই, রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে চালকদের নিবন্ধন যাচাই, প্রযুক্তিনির্ভর ট্রাফিক তদারকি এবং গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক সচেতনতামূলক উদ্যোগ গ্রহণের।
সড়কে প্রতিদিন যে মৃত্যু মিছিল চলছে, তা থামাতে হলে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই কারো—না সরকারের, না নাগরিক সমাজের, না গণমাধ্যমের। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী প্রজন্মকে আমরা রেখে যাব একটি বিপজ্জনক ও অনিরাপদ রাস্তার দেশ।