বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, সন্দ্বীপ ( চট্টগ্রাম): বন্দরঘেঁষা দ্বীপ সন্দ্বীপ। একসময় এখানে মাছ ধরাই ছিল পেশা, আজ সেই পেশা পেরিয়ে সন্তানরা ছুটছে মরুভূমির বুকে জীবনের খোঁজে। দুবাই, রিয়াদ, শারজাহ নামগুলো এখন শুধু বিদেশ নয়, হয়ে উঠেছে স্বপ্নের সমার্থক। কিন্তু সেই স্বপ্নের পেছনে থাকে অনেক লোনা ঘাম, বহুদিন না দেখা মা, অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস। “ভাইজান, প্রতিদিন মাটির গন্ধ লাগে… কিন্তু এসেছি তো কাজ করতে ,” বলছিলেন ২৯ বছর বয়সী সায়েম, রিয়াদের একটি কন্সট্রাকশন সাইট থেকে হোয়াটসঅ্যাপে।
আজকের দিনে সন্দ্বীপের প্রায় প্রতিটি ঘরে একাধিক সদস্য প্রবাসে। কেউ আছেন সৌদি আরবে, কেউ কাতারে, কেউ বা ইতালি, মালয়েশিয়া বা আমেরিকায়।
সন্দ্বীপের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখন প্রবাসে। অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে । কেউ ওয়েল্ডার, কেউ ড্রাইভার, কেউবা হোটেলবয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসেবে সন্দ্বীপ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ২০ কোটি টাকার রেমিটেন্স পাঠানো হয়।
এই টাকাতেই বদলাচ্ছে দ্বীপের দৃশ্যপট। ইটের বাড়ি, মেটাল গেট, থাই গ্লাসের জানালা সবই সেই টাকার সাক্ষী। “আমার বড় ছেলের পাঠানো টাকায়ই দুই তলা ঘর তুলছি,” বলেন ৬০ বছরের আয়েশা বেগম, গামছা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে।
প্রবাসীরা শুধু টাকা পাঠায় না, পাঠায় বেঁচে থাকার গল্প। অনেকের বাবা-মা এখন নিঃসঙ্গ। ঈদে বাড়ি আসতে পারে না সবাই। এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী বিচ্ছেদ তৈরি হয়েছে।
সন্দ্বীপের দক্ষিণ কোলে একটি চায়ের দোকানে সন্ধ্যার আড্ডায় এক বৃদ্ধ বলছিলেন: “আমার তিন ছেলে বিদেশ… ঘরে আলু তরকারি আছে, কিন্তু তাদের মুখ দেখি না বছর দুই হলো।”
প্রবাসীরা এখন নিয়মিত ভিডিও কলে কথা বলেন, মোবাইল ফ্রিতে মায়ের খোঁজ নেন। সন্দ্বীপে এখন ফাইবার অপটিক লাইন, বাড়িতে স্মার্ট টিভি—সবই প্রবাসীদের অবদান।
একজন বলছিলেন, “মা’র চোখে পানি দেখলেই মন ভেঙে যায় ভাই। কিন্তু বউ, বাচ্চা সবার খরচ তো লাগেই।”
সন্দ্বীপ এখন আর নিছক একটি দ্বীপ নয়, এটি একটি রেমিটেন্স-নির্ভর অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। তবে উন্নয়নের গল্পের পাশাপাশি, প্রবাসজীবনের কষ্ট, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং স্থানীয় যুবকদের বিদেশমুখী ঝোঁক নিয়ে গবেষণা দরকার।
সাগরের পাড়ে জন্ম হলেও, সন্দ্বীপের তরুণদের স্বপ্ন এখন মরুভূমির রোদে ভেজা। তারা ফিরে আসে না চট করে। কিন্তু টাকা আসে, গল্প আসে, আর আসতে আসতে তারা বদলে দেয় একটি দ্বীপের অর্থনীতি ও জীবনচিত্র।
প্রবাসীরাই সন্দ্বীপের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন। স্থানীয় বাজারে বিল্ডিং নির্মাণ, আধুনিক ঘরবাড়ি, ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশোনা সবই সম্ভব হয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে।
সন্দ্বীপ সদর, হারামিয়া, কালাপানিয়া কিংবা গামছাখালী প্রতিটি এলাকায় এখন “প্রবাসী বাড়ি” শব্দটা গর্বের প্রতীক।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রবাসে যাওয়ার আগ্রহ অনেকটাই কমে এসেছে।
তারা বলছে, “বাবা মরুভূমিতে জীবন কাটিয়েছেন, আমি চাই না একই জীবন।”
বিভিন্ন পেশায় প্রযুক্তির প্রসার, দেশের ভিতরে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং ভিন্ন জীবনধারণের আকাঙ্ক্ষা তাদের ভাবনাকে বদলে দিচ্ছে।
সন্দ্বীপের প্রবাসীরা শুধু রেমিটেন্স পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন না। গত বছর ঈদের সময় তারা প্রায় ৩০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন স্থানীয় স্কুল, মসজিদ ও ক্লিনিকে। কেউ পাঠিয়েছেন ওষুধ, কেউ এনেছেন চিকিৎসক বন্ধুদের সঙ্গে। এসবই প্রমাণ করে—এই মানুষগুলো শুধু বিদেশে কাজই করেন না, বরং তাদের টান এখনো মাটির গভীরে বাঁধা।