কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বজুড়ে গুরুত্ব পাচ্ছে ব্লু ইকোনোমি বা সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে টেকসই কৌশল গ্রহণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
বিশ্বের উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলো যখন এই খাতে বিপুল বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, তখন সমুদ্রসীমা সম্প্রসারণের এক দশক পেরিয়ে এলেও বাংলাদেশ এখনো সম্ভাবনার দ্বারেই দাঁড়িয়ে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট:
জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের মতে, ব্লু ইকোনোমি বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক কার্যক্রম সৃষ্টি করছে।
বিশ্বে অন্তত ৩ বিলিয়ন মানুষ তাদের জীবিকা ও খাদ্যের জন্য সমুদ্রনির্ভর। উন্নত দেশগুলো ব্লু ইকোনোমিকে তাদের কৌশলগত অর্থনৈতিক স্তম্ভ হিসেবে দেখছে।
ইন্দোনেশিয়া ব্লু ইকোনোমিকে জাতীয় প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং সমুদ্র পরিবহন, পর্যটন ও সামুদ্রিক কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
চীন তাদের ব্লু ইকোনোমি পরিকল্পনায় মেরিন বায়োটেকনোলজি, অফশোর রিনিউএবল এনার্জি এবং গভীর সমুদ্র খননকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আফ্রিকার উপকূলীয় দেশগুলোও সমুদ্রসম্পদ থেকে আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিচ্ছে।
ব্লু ইকোনোমি এখন বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG 14) সরাসরি সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
২০১২ ও ২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ পেয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার বিশাল সমুদ্রসীমা।
এই ব্লু ইকোনোমি জোনে রয়েছে:
- বিপুল পরিমাণ মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীসম্পদ,
- সম্ভাব্য গ্যাস ও খনিজ মজুদ,
- সমুদ্র পর্যটন,
- বন্দর উন্নয়ন,
- সমুদ্র পরিবহন ও নৌ-শিল্প।
বাংলাদেশ সরকার “ব্লু ইকোনোমি নীতি ২০২০” প্রণয়ন করেছে, যার আওতায় ২৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সমন্বয় করে একটি জাতীয় রোডম্যাপ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে বাস্তবায়ন অনেকাংশেই ধীরগতির। এখনো সামুদ্রিক গবেষণা ও নকশাগত উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হয়নি। দক্ষ মানবসম্পদের অভাব, সমন্বয়হীনতা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সম্ভাবনা বনাম চ্যালেঞ্জ:
বাংলাদেশের সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি বর্তমানে জাতীয় জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশের মতো। অথচ উপযুক্ত পরিকল্পনা ও বিনিয়োগে ২০৩০ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ করার সুযোগ রয়েছে। পরিবেশবান্ধব সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা, আধুনিক মৎস্যপ্রযুক্তি, গভীর সমুদ্র অন্বেষণ, নীল জ্বালানি এবং সমুদ্র পর্যটন বাড়ানোর মাধ্যমে ব্লু ইকোনোমির পরিধি বাড়ানো সম্ভব।
ব্লু ইকোনোমি শুধু উন্নয়ন নয়, এটি টেকসই ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি। বাংলাদেশের জন্য এটি হতে পারে নতুন বৈদেশিক মুদ্রার উৎস, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র এবং কৌশলগত নিরাপত্তার মাধ্যম।
তবে এজন্য দরকার স্পষ্ট নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি নীতি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং দক্ষ জনবল গড়ে তোলা।