বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, রাজশাহী:
আমরা গভীর দুঃখ, বেদনা আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি যে, সারাদেশের কোটি মানুষের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা আর ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ৩২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর, বিরামহীন অভিযানের পর সাজিদ উদ্ধার পেল ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীর আলো-বাতাস তাকে আর ছুঁতে পারল না। মাটির গভীর অন্ধকার থেকে যখন তাকে ওপরে তুলে আনা হলো, তখন সে এক নিথর পুষ্পকলি।
বৃহস্পতিবার ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৯টা। রাজশাহীর তানোর উপজেলার কামারগাঁ ইউনিয়নের হাবিবপুর গ্রাম তখন স্তব্ধ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন গভীর পাইপের অন্ধকূপ থেকে দুই বছরের শিশু সাজিদের দেহটি বের করে আনলেন, তখন চারপাশের হাজারো জনতার অপেক্ষার কোলাহল নিমিষেই রূপ নিল এক শ্মশানসম নীরবতায়। বিজয়ের উল্লাস নয়, বাতাসে তখন শুধুই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।
জীবনের কাছে হেরে গেল সময়
গত বুধবার সকালের সোনাঝরা রোদে খেলছিল ছোট্ট সাজিদ। কে জানত, খেলার ছলে বাড়ির পাশের ওই ৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপটিই হয়ে উঠবে তার মরণফাঁদ? মুহূর্তের অসতর্কতায় সে তলিয়ে যায় মাটির গভীরে। খবর পেয়েই ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও প্রশাসন। শুরু হয় জীবনের জন্য যুদ্ধ। পাইপের মুখ সরু হওয়ায় উদ্ধারকর্মীরা নামতে পারছিলেন না, তাই পাশে খোঁড়া হয় সমান্তরাল গর্ত। অত্যাধুনিক ক্যামেরা, রশি, আর প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলে টানা ৩২ ঘণ্টা। কিন্তু মাটির নিচের হিমশীতল ঠান্ডা আর অক্সিজেনের তীব্র অভাবের কাছে হার মানতে হয় ছোট্ট ফুসফুসটিকে।
চিকিৎসকদের বক্তব্য
উদ্ধারের পরপরই সাজিদকে দ্রুত নেওয়া হয় তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জন্য অপেক্ষা করছিল দুঃসংবাদ। পরীক্ষার পর তাঁরা জানান, হাসপাতেল আনার বহু আগেই শিশুটি মারা গেছে। দীর্ঘ সময় মাটির গভীরে আটকে থাকায় হাইপোক্সিয়া (অক্সিজেনের অভাব) এবং হাইপোথার্মিয়া (শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া) তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মায়ের আঁচল শূন্য, বাবার বোবা কান্না
সাজিদের বাবা কুদরত উল্লাহ আর মায়ের আর্তনাদে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। যে সন্তানের হাসিতে পুরো বাড়ি আলোকিত থাকত, সে আজ কেবলই স্মৃতি। উদ্ধার অভিযানের প্রতিটি মুহূর্তে মা যে আশা বুকে বেঁধে রেখেছিলেন, তা মুহূর্তেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। সাজিদের খেলনাগুলো পড়ে আছে, শুধু নেই সেই ছোট্ট হাতদুটো যা ওগুলো নিয়ে খেলত।
প্রার্থনা ও শেষ কথা
সাজিদ চলে গেছে না ফেরার দেশে, হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাকে দুনিয়ার এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতের পাখি হিসেবে কবুল করেছেন। আমরা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন নিষ্পাপ শিশুটিকে জান্নাতবাসী করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পিতা-মাতাকে এই পাহাড়সম শোক সইবার শক্তি ও ধৈর্য দান করেন।
সাজিদের এই করুণ বিদায় আমাদের বিবেকের কাছে এক বড় প্রশ্ন রেখে গেল—আর কত সাজিদকে এভাবে অকালে ঝরে পড়তে হবে? অরক্ষিত বোরওয়েল বা পাইপ যেন আর কোনো মায়ের কোল খালি না করে, সেটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
বিদায়, ছোট্ট সাজিদ। ওপারে ভালো থেকো তুমি।









