বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, খুলনা: রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থাকা যুবদল নেতা এস এম শামীম (৩৬)-এর হত্যাকাণ্ড শুধু একটি অপরাধের ঘটনা নয়, বরং গ্রামীণ সমাজ, পারিবারিক টানাপোড়েন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ চিত্র। মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) পুলিশ সংবাদ সম্মেলনে জানায়, শামীমকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার বৃষ্টি (২৮) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে তার মামাতো ভাই ওবায়দুল্লাহ, যিনি হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শামীম দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী বৃষ্টিকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। অভিযোগ অনুযায়ী, এই নির্যাতনের ফলে বৃষ্টির মধ্যে একপ্রকার প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হয়। ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকেই তিনি শামীমকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটেন এবং এতে সহযোগিতা করতে মামাতো ভাই ওবায়দুল্লাহকে যুক্ত করেন। হত্যার রাতে শামীমকে ঘুম পাড়ানোর পর পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃষ্টি ইশারায় নির্দেশ দেন কীভাবে আঘাত করতে হবে। এরপর ওবায়দুল্লাহ ছুরি দিয়ে শামীমের ঘাড়ে কোপ দেন, যা ছিল মৃত্যুঘাতী।
যে ছুরি দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, সেটি শামীম নিজেই কয়েক দিন আগে স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। হত্যার পর ছুরিটি পাশের জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, এ ধরনের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সাধারণ পারিবারিক দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে একটি শীতল মাথার অপরাধ হিসেবে ধরা পড়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শামীম রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। তবে পরিবারে কলহ এবং ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতা তাকে ক্রমে ভেতর থেকে দুর্বল করে তোলে। তার তিনতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় প্রায়ই বহিরাগত মাদকসেবীদের আড্ডা বসত, যেখানে যেতেন শামীমও। এই প্রেক্ষাপট পারিবারিক সম্পর্কে ভাঙন আরও তীব্র করে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক অশান্তি যখন নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা প্রায়ই নারীদেরকে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতে ঠেলে দেয়।
খুলনা জেলা পুলিশ ও র্যাব-৬-এর যৌথ অভিযানে হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী ও শ্যালককে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সুপার টি এম মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, বৃষ্টির স্বীকারোক্তি এবং উদ্ধার করা আলামত মামলার শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। এরই মধ্যে বৃষ্টিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ওবায়দুল্লাহকে যশোর কিশোর সংশোধনাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারের করুণ পরিণতি নয়, বরং বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পারিবারিক সহিংসতা, নারীর ওপর নির্যাতন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের একটি বড় প্রতিচ্ছবি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আইনি কাঠামোর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা প্রয়োজন।
ডুমুরিয়ার এই হত্যাকাণ্ড মনে করিয়ে দেয়—পারিবারিক কলহ যখন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আইনি বা সামাজিক সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন তা ভয়াবহ রূপ নেয়। যুবদল নেতা শামীমের মৃত্যু একদিকে পারিবারিক সহিংসতার করুণ ফলাফল, অন্যদিকে সমাজের নৈতিক ও সামাজিক ভাঙনের প্রতিচ্ছবি। তদন্তে যদি আরও তথ্য বেরিয়ে আসে, তবে হয়তো এই হত্যার পেছনের গভীরতর কারণগুলোও স্পষ্ট হবে।