Home First Lead উন্নয়নের ছায়ায় ধুলো: সিমেন্ট শিল্পের অগ্রগতি বনাম স্বাস্থ্যঝুঁকি

উন্নয়নের ছায়ায় ধুলো: সিমেন্ট শিল্পের অগ্রগতি বনাম স্বাস্থ্যঝুঁকি

আমিরুল মোমেনিন, ঢাকা: দেশের দ্রুত বাড়তে থাকা অবকাঠামোগত চাহিদার মধ্যে সিমেন্ট শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভবন, সেতু, রাস্তাঘাট সবই গড়ে উঠছে এই শিল্পের অবদান ছাড়া। কিন্তু যে অগ্রগতির গল্প আমরা দেখি, তার পেছনে লুকিয়ে আছে অসংখ্য শ্রমিক এবং আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি। প্রতিদিনের জীবনে এই ধুলো তাদের ফুসফুস ও রক্তকে অঙ্গীভূত ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ছবি এ আই
ধুলো এক্সপোজার ও শারীরিক প্রভাব

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের গবেষণা অনুযায়ী, যারা সিমেন্ট ধুলোর সরাসরি সংস্পর্শে কাজ করছেন, তাদের ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। ফুসফুসের ক্ষমতা পরিমাপের মান যেমন FVC (ফোর্সড ভাইটাল ক্যাপাসিটি) ও FEV₁ (ফোর্সড এক্সপিরেটরি ভলিউম) নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। শ্বাসপ্রবাহের সর্বোচ্চ হার (PEFR) এর মানও ধুলো এক্সপোজারে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে কম দেখা গেছে।

এছাড়া, ধুলোর সংস্পর্শে থাকা কর্মীদের রক্তে সাদা কণিকা এবং ইয়োসিনোফিলের সংখ্যা বেড়ে যায়। এটি প্রদাহ বা শোষণপ্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। ঢাকার আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় সিমেন্ট ধুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের রক্তের লোহিত কণিকা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমছে। দীর্ঘমেয়াদি এই ক্ষতি শুধু শারীরিক দুর্বলতা নয়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।

ধুলোর গুণগত বৈশিষ্ট্য ও ঝুঁকি

একটি গবেষণায় বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পের ধুলোতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কণা (PM₂.₅) এবং আল্ট্রাফাইন কণা (PM₀.₁) পাওয়া গেছে। বিশ্লেষণ দেখিয়েছে, ধুলোর মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম এবং উদ্বেগজনকভাবে ক্রিস্টালাইন সিলিকা ও অ্যাসবেসটস। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসনালার গভীর অংশে প্রবেশ করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসনালীজনিত রোগ, ফুসফুসের প্রদাহ এবং এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ

গবেষণাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রী যেমন মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা দরকার। কিন্তু অনেক কারখানায় পর্যাপ্ত ধুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও পর্যবেক্ষণ নেই। ধুলো নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাগুলোও প্রায়ই অপ্রতুল। শিল্প সম্প্রসারণ যত দ্রুত, দূষণ নিয়ন্ত্রণে নীতিগত ও প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ তত দ্রুত সঙ্গ দেয় না।

পরিবেশগত প্রভাবও ব্যাপক। ধুলো শুধু শ্রমিকদের নয়, আশপাশের বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, কাশি ও ফুসফুস সংক্রান্ত সমস্যা বাড়ছে।

সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ

কঠোর স্বাস্থ্য-নিয়ম: প্রতিটি কারখানায় নিয়মিত ফুসফুস এবং রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রশিক্ষণ দেওয়া।

উন্নত ধুলো নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি: ধুলো কমাতে উন্নত ব্যাগ ফিল্টার, সিলো সিস্টেম, কভারড স্টোরেজ এবং অভ্যন্তরীণ রোডে ধুলো কমানোর ব্যবস্থা সম্প্রসারণ।

পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ও স্বচ্ছতা: প্রতিটি সিমেন্ট মিলের ধুলো নির্গমন নিয়মিত মাপা ও রিপোর্ট প্রকাশ করা। এটি সরকার, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের জন্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।

নীতিগত সমন্বয়: পরিবেশবিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে ধুলো-নির্গমন মান কঠোরভাবে নির্ধারণ করতে হবে। শিল্পকে নিরাপদ ও টেকসই মডেলে পরিচালনা করার জন্য কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি: কমিউনিটি, আশপাশের মানুষ এবং শ্রমিকদের মধ্যে ধুলো ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি।

 সিমেন্ট শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর ছায়ায় লুকিয়ে আছে বিস্তৃত স্বাস্থ্যঝুঁকি। সূক্ষ্ম ও ক্ষতিকর কণিকা, প্রদাহপ্রতিক্রিয়া এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাসের মতো সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। উন্নয়ন ও নিরাপদ পরিবেশের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য না থাকলে, এই শিল্প শুধু ভবন গড়বে না, মানুষের স্বাস্থ্যের ভিত্তিতেও বিপর্যয় আনতে পারে। এখন সময় এসেছে শুধু অর্থনীতিকে নয়, মানুষের জীবনকেও প্রথমে বিবেচনার।