আজহার মুনিম, লন্ডন: লন্ডনের রাস্তায় হাঁটলেই চোখে পড়ে একের পর এক “ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট”। কিন্তু এই নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল সিলেটি অধ্যায়ের গল্প—যা শুধু খাবারের নয়, বরং সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। ব্রিটিশ কারিহাউস শিল্পের মূলে রয়েছে বাংলাদেশ, বিশেষত সিলেটের অভিবাসীদের অবদান।
লন্ডনে সিলেটি বাঙালিদের আগমন শুরু হয় ১৯শ শতকের শেষভাগে ও ২০শ শতকের শুরুতে, যখন তারা ব্রিটিশ জাহাজে লাসকার হিসেবে কাজ করতেন। অনেকেই পরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ইস্ট লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায়। ১৯২০ সালে আয়ুব আলী মাস্টার নামে এক সিলেটি প্রথমবারের মতো লন্ডনে Shah Jalal Restaurant and Coffee House চালু করেন। এটি ছিল শুধু খাবারের জায়গা নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু।
১৯৭০-এর দশকে ব্রিটেনে কারি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। সিলেটি উদ্যোক্তারা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক রেস্টুরেন্ট খুলতে থাকেন। ১৯৮০-এর দশকে প্রায় ৩,০০০ কারিহাউস ছিল, যার অধিকাংশই সিলেটিদের মালিকানাধীন। আজকের দিনে ৮,৫০০ ভারতীয় রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রায় ৭,২০০ পরিচালিত হয় বাংলাদেশিদের দ্বারা, যার ৯৫% এর মালিক সিলেটি। চিকেন টিক্কা মাসালা, ল্যাম্ব ভিন্ডালু, শাটকরা গরুর মাংস—এইসব পদ শুধু বাঙালিদের নয়, বরং ব্রিটিশদের রাতের খাবারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
কারিহাউসগুলো শুধু ব্যবসা নয়, বরং সামাজিক সংযোগের কেন্দ্র। এগুলো প্রবাসী বাঙালিদের জন্য কর্মসংস্থান, পরিচয় এবং সংস্কৃতির বাহক। ব্রিক লেন, হোয়াইটচ্যাপেল, স্টেপনি—এই এলাকাগুলোতে রয়েছে জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট যেমন Gram Bangla, Kolapata, Sonargaon ইত্যাদি, যেগুলো সিলেটি স্বাদে ভরপুর।
সিলেটি কারিহাউস শিল্প ব্রিটিশ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বার্ষিক আয় প্রায় ৪.২ বিলিয়ন পাউন্ড, কর্মসংস্থান প্রায় ১ লক্ষ লোক, এবং হাজার হাজার সিলেটি পরিবার এই শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে।
তবে এই শিল্প এখন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ইমিগ্রেশন আইন কঠোর হওয়ায় দক্ষ রাঁধুনিদের পাওয়া কঠিন, নতুন প্রজন্ম অনেক সময় এই ব্যবসায় আগ্রহী নয়, এবং ব্রিটিশ খাদ্যরুচির পরিবর্তন ও প্রতিযোগিতা বাড়ছে। British Curry Awards-এর প্রতিষ্ঠাতা এনাম আলি একবার বলেছিলেন, “আমরা শুধু খাবার পরিবেশন করি না, আমরা সংস্কৃতি পরিবেশন করি।”
যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও সিলেটি কারিহাউসগুলো তাদের ঐতিহ্য, স্বাদ ও আতিথেয়তা দিয়ে এখনও ব্রিটিশ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নতুন প্রজন্ম যদি এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখে, প্রযুক্তি ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা যুক্ত করে, তবে এই শিল্প আরও বহু বছর টিকে থাকবে এবং বিশ্বজুড়ে “সিলেটি কারি” নামটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
লন্ডনের সিলেটি কারিহাউস শুধু একটি ব্যবসা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। এটি প্রমাণ করে, স্বাদ দিয়ে সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, এবং একটি ছোট শহরের মানুষও বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিতে পারে।