বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক:বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি পৃথিবী থেকে মাত্র ২০ আলোকবর্ষ দূরে একটি নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে জিজে ২৫১ সি (GJ 251 c)। এটি পৃথিবীর তুলনায় অন্তত চার গুণ বড় এবং শিলা-ভিত্তিক বা পাথুরে গ্রহ বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই গ্রহটি তার নক্ষত্রের ‘গোল্ডিলকস জোনে’ অবস্থান করছে—অর্থাৎ এমন এক অঞ্চলে যেখানে তরল পানি থাকতে পারে এবং প্রাণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব।
আন্তর্জাতিক গবেষকদলের মতে, এ কারণে জিজে ২৫১ সি এখন পর্যন্ত প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাময় অন্যতম সেরা প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গবেষকেরা এই গ্রহটির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন তার নক্ষত্রের সূক্ষ্ম দোলন বা ‘ওবল’ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। গত ২০ বছরের পর্যবেক্ষণ ডেটা পরীক্ষা করে তাঁরা লক্ষ্য করেন, নক্ষত্রের এই ক্ষুদ্র দোলন মূলত গ্রহের মহাকর্ষীয় টানের কারণে ঘটে। যদিও এই পদ্ধতিতে গ্রহের পৃষ্ঠের অবস্থা জানা যায় না, তবে এটি বলে দেয় গ্রহটি জীবনের উপযোগী দূরত্বে রয়েছে কিনা।
পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুভ্রত মহাদেবন ডেইলি মেইলকে বলেন, “এই আবিষ্কার আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বাইরে জীবনের বায়ুমণ্ডলীয় স্বাক্ষর অনুসন্ধানে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুযোগ তৈরি করেছে।”
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন যে জিজে ২৫১ সি–এর কোনো বায়ুমণ্ডল আছে কিনা। তবে তাঁরা আশা করছেন, নতুন প্রজন্মের টেলিস্কোপ প্রযুক্তি আগামী এক দশকের মধ্যে এই রহস্য উদঘাটন করতে পারবে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন, সৌরজগতের বাইরের এমন গ্রহগুলোকে এক্সোপ্ল্যানেট বলা হয়, যেগুলো এত দূরে ও ক্ষীণ যে সাধারণ টেলিস্কোপে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়। বরং বিজ্ঞানীরা সেসব নক্ষত্রের আলো বিশ্লেষণ করেন, যেগুলোর কক্ষপথে এসব গ্রহ ঘুরছে। যখন কোনো গ্রহ তার নক্ষত্রকে টানে, তখন নক্ষত্রও সামান্য দোল খায়—এই দোল থেকেই গ্রহের অস্তিত্ব বোঝা যায়।
অধ্যাপক মহাদেবন ব্যাখ্যা করেন, “আমরা সাধারণত শেখানো হয় যে গ্রহ নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে, কিন্তু বাস্তবে নক্ষত্র ও গ্রহ উভয়ই তাদের সম্মিলিত ভরকেন্দ্রের চারপাশে ঘোরে।” পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহের টানে সূর্যের এই দোলন বছরে মাত্র নয় সেন্টিমিটার হয়, কিন্তু জিজে ২৫১ সি যেহেতু অনেক বড়, তাই তার প্রভাব সহজেই শনাক্তযোগ্য হয়েছে।
এই গ্রহ আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন ‘হ্যাবিটেবল জোন প্ল্যানেট ফাইন্ডার (HPF)’ নামের এক বিশেষ যন্ত্র, যা নক্ষত্রের আলোর সংকেত ভেঙে বিশ্লেষণ করে। দীর্ঘ দুই দশকের পর্যবেক্ষণে তাঁরা আগেই জানতেন যে একই নক্ষত্রের চারপাশে জিজে ২৫১ বি (GJ 251 b) নামের আরেকটি গ্রহ ঘুরছে, যার কক্ষপথ সম্পন্ন হতে সময় লাগে মাত্র ১৪ দিন। কিন্তু আরও গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি ৫৪ দিনে একটানা আরেকটি শক্তিশালী সংকেত পুনরাবৃত্তি হচ্ছে—যা নতুন গ্রহ জিজে ২৫১ সি–এর উপস্থিতি নিশ্চিত করে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিজে ২৫১ সি তার নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে ঘুরছে, যেখানে উপযুক্ত বায়ুমণ্ডল থাকলে তরল পানি টিকে থাকতে পারে। এই ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে দ্য অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নালে।
অধ্যাপক মহাদেবনের মতে, “জিজে ২৫১ সি এমন এক দূরত্বে অবস্থিত যেখানে জীবনের জন্য অনুকূল পানি থাকতে পারে। আরও আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, এটি পৃথিবী থেকে মাত্র ২০ আলোকবর্ষ দূরে—যা ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য সহজগম্য।”
যদিও বর্তমান প্রযুক্তিতে মানুষ সেখানে পৌঁছাতে পারবে না, তবে পৃথিবীতেই উন্নত টেলিস্কোপ দিয়ে এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল ও সম্ভাব্য প্রাণের চিহ্ন বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে বলে গবেষকেরা মনে করছেন।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৩০ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট নতুন প্রজন্মের স্থলভিত্তিক টেলিস্কোপ চালু হলে বিজ্ঞানীরা এই ধরনের গ্রহ সরাসরি চিত্রায়ণ করতে পারবেন। ইতিমধ্যেই গবেষকেরা জিজে ২৫১ সি–এর সম্ভাব্য বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে কম্পিউটার সিমুলেশন তৈরি করেছেন।
সহ–লেখক ড. কোরি বিআর্ড বলেন, “আমরা বর্তমানে প্রযুক্তি ও বিশ্লেষণের সর্বাধুনিক সীমায় পৌঁছে গেছি। এই গ্রহটিকে সরাসরি চিত্রায়ণের জন্য পরবর্তী প্রজন্মের টেলিস্কোপ প্রয়োজন, এবং এ জন্য বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের বিনিয়োগ অপরিহার্য।”
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জীবনের রাসায়নিক চিহ্ন বা ‘বায়োসিগনেচার’ পাওয়া গেলে তা হবে পৃথিবীর বাইরের প্রাণের সন্ধানে মানবজাতির এক ঐতিহাসিক অগ্রগতি।










