বিজেনসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: নব্বইয়ের দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড মানেই ছিল ভয়, রক্ত আর আধিপত্যের লড়াই। মগবাজার থেকে গুলিস্তান, মতিঝিল থেকে সিদ্ধেশ্বরী প্রতিটি এলাকাই যেন ছিল কোনো না কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে। সেসব ভয়ংকর দিনের আলোচিত নাম সুব্রত বাইন। মগবাজারের এক রেস্টুরেন্টের কর্মচারী থেকে তিনি রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন ‘সেভেন স্টার’ গ্যাংয়ের প্রধান, ঢাকার অপরাধজগতের কুখ্যাত ডন। গতকাল (২৭ মে) সেই সুব্রত বাইনকে কুষ্টিয়া থেকে সেনাবাহিনীর হাই-প্রোফাইল অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সঙ্গে ধরা পড়েছে তার ‘শিষ্য’ মোল্লা মাসুদসহ আরও দুই সহযোগী।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, অন্তত ৩০টি খুন, শতাধিক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী হামলার মামলায় পলাতক ছিল এই দুজন। সুব্রত বাইন ওরফে ত্রিমতির বয়স এখন ৫৬। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে এখনও রয়েছে তার ‘রেড নোটিশ’। এক সময় ঢাকার ত্রাস সুব্রত, ভারতের কলকাতা, নেপাল ও দুবাই হয়ে আবার ফিরেছেন আলোচনায়।
‘চাংপাই’ কর্মচারী থেকে ‘গডফাদার’!
সুব্রতের শিকড় বরিশালের আগৈলঝড়ার জোবারপাড় গ্রামে। ঢাকায় উঠে মা ও তিন বোনকে নিয়ে থাকতেন মগবাজারে। পড়াশোনার ইতি এসএসসির পর, চাকরি নেন চাংপাই চায়নিজ রেস্টুরেন্টে। কিন্তু সেই সরল জীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। খুব দ্রুতই ঢুকে পড়েন অপরাধজগতে। গঠন করেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী ‘সেভেন স্টার’। একে একে চলে আসেন পুলিশের নজরে।
১৯৯৩ সালে মধুবাগের এক খুনে তার নাম আসে প্রথমবার। এরপর মগবাজারের বিশাল সেন্টারে চাঁদাবাজি নিয়ে ভয়ংকর গোলাগুলিতে সুব্রত উঠে আসে খবরের শিরোনামে। পরবর্তী কয়েক বছরেই তিনি হয়ে ওঠেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ হোতা।
রোমাঞ্চকর পালিয়ে বেড়ানো, নেপালের জেল থেকে সুড়ঙ্গপথে পলায়ন:
২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে, তাতে শীর্ষ নাম ছিল সুব্রত বাইনের। এরপর তিনি পালিয়ে যান ভারতে, বিয়ে করেন পশ্চিমবঙ্গের এক নারীকে। কাগজপত্র তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু ধরা পড়েন কলকাতা পুলিশের হাতে। জামিনে মুক্ত হয়ে চলে যান দুবাই। আবার ফিরে এসে এক নায়িকার কাছে চাঁদা চাইলে ফের অভিযান শুরু হয়।
পালিয়ে যান নেপালে। ২০১২ সালে সেখানকার ঝুমকা জেলে আটক থাকা অবস্থায় ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে পালিয়ে যান তিনি ও আরও ৯ বন্দি। খবর ছড়ায় দেশ-বিদেশে। পরে ফের কলকাতায় ধরা পড়েন। এরপর দীর্ঘদিন তিনি আড়ালে ছিলেন।
নিজের স্ত্রীকে ‘বিয়ে’ দেন অন্যকে!
সুব্রতের জীবন ছিল নাটকীয়তায় ভরা। জেলে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী লুসি প্রেমে পড়েন সুব্রতেরই এক সহযোগীর। বিষয়টি জানার পর জেল থেকে বেরিয়ে সুব্রত নিজেই সেই সহযোগীর সঙ্গে স্ত্রীকে বিয়ে দেন। দুই সন্তান রেখে চলে যান। পরে কুমিল্লার এক নারী বিউটিকে বিয়ে করলেও সে সম্পর্কও টেকেনি।
মোল্লা মাসুদ: শিষ্য থেকে সন্ত্রাসী
মতিঝিলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ সুব্রতের হাত ধরেই ঢুকে পড়েন অপরাধ জগতে। পরে নিজেই হয়ে ওঠেন ভয়ংকর। তার বিরুদ্ধে রয়েছে এমপি কামালের ভাগনে মামুন হত্যাসহ একাধিক ট্রিপল মার্ডারের অভিযোগ। ভারতীয় এক নারীকে বিয়ে করে সেখানেই পাড়ি জমান। পরিচিত হন ‘আবু রাসেল মো. মাসুদ’ নামে। ২০১৫ সালে ভারতে ধরা পড়েন, পরে জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপন করেন।
এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর ফের গ্রেপ্তারের খবরে নড়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দীর্ঘদিন ধরে যারা ছিল পলাতক, তাদের পাকড়াও হওয়া মানে পুরনো বহু মামলার জট খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা।