বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কলকাতা: মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় রাতের অন্ধকারে গোপনে পাচার করা হচ্ছিল বিরল প্রজাতির সোনালি বাঁদর, যাদের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কোটি টাকারও বেশি। তবে শেষরক্ষা হয়নি। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে তৎপর হয় বেলডাঙা থানার পুলিশ। অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় চারটি সোনালি বাঁদর এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছয় পাচারকারীকে। শুক্রবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটে ১২ নম্বর জাতীয় সড়কে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পাচারের গোপন তথ্য পাওয়ার পরেই বেলডাঙা ও আশপাশের এলাকায় চালানো হয় নাকা চেকিং। জাতীয় সড়কের উপর গভীর রাতে দাঁড় করানো হয় দুটি চারচাকা গাড়ি। তল্লাশির সময় পুলিশ দেখে গাড়ির ভিতরে রয়েছে মুখবাঁধা একাধিক বস্তা। সন্দেহ হওয়ায় সেই বস্তাগুলো খুলতেই চমকে ওঠেন পুলিশ সদস্যরা। দেখা যায়, বস্তাগুলির ভিতরে বন্দি অবস্থায় রয়েছে চারটি সোনালি বাঁদর।
ধৃত ছয় পাচারকারী হলেন—মিঠু দাস (নদিয়ার বাসিন্দা), টিটু দাস, শামিল হোসেন, রফিকুল মণ্ডল, হাসিবুল মণ্ডল ও বিশ্বজিৎ বাগ। এদের মধ্যে মিঠু দাসই পাচারচক্রের মূল পান্ডা বলে জানিয়েছেন বেলডাঙার এসডিপিও উত্তম গড়াই। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, এই বাঁদরগুলি সম্ভবত আফ্রিকা থেকে এনে কলকাতা হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ পাচারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যদিও এই মুহূর্তে সঠিক উত্স ও গন্তব্য নিয়ে তদন্ত চলছে। ধৃতদের জেরা করে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে—এই পাচারচক্রের পেছনে আরও বড় কোনো চক্র কাজ করছে কি না।
উদ্ধার হওয়া প্রাণীগুলিকে ইতিমধ্যে বনদপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
সোনালি বাঁদর: কোন প্রজাতি, কোথায় বাস?
সোনালি বাঁদর, বা গোল্ডেন মাঙ্কি, প্রকৃতপক্ষে নীল বাঁদরের একটি উপপ্রজাতি (Blue Monkey subspecies)। বৈজ্ঞানিক নাম Cercopithecus mitis kandti। এগুলিকে ইংরেজিতে Golden Monkey বা Golden Blue Monkey বলা হয়। প্রধানত মধ্য আফ্রিকার রুয়ান্ডা, উগান্ডা ও কঙ্গোর জঙ্গলেই এই প্রজাতির বাঁদর পাওয়া যায়। ঘন জঙ্গল এবং উঁচু ভূমিতেই এরা বাস করে। দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়—তাদের শরীরে সোনালি বাদামি ও ধূসর রঙের মিশ্রণ থাকে। এদের অস্তিত্ব এখন সংকটাপন্ন, কারণ জঙ্গল ধ্বংস, শিকার ও পাচারের ফলে এদের সংখ্যা দিন দিন কমছে।
সোনালী বাঁদরের যে প্রজাতিটি বেলডাঙা থানার পুলিশ উদ্ধার করেছে তা ভারতবর্ষে বিরল। পৃথিবীতে বাঁদরের যে প্রজাতিগুলো সর্বপ্রথম আবির্ভূত হয়েছিল সোনালী বাঁদর তার মধ্যে অন্যতম। মূলত দক্ষিণ–মধ্য আফ্রিকা, উগান্ডা, কঙ্গো সহ আরও কয়েকটি দেশের ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই প্রজাতির বাঁদরকে দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের কয়েকটি জঙ্গলেও খুব কম সংখ্যায় এদের অস্তিত্ব রয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের’ তালিকায় অতি বিরল এই বাঁদর লাল তালিকাভুক্ত। এর পাশাপাশি ভারত সরকারের বনদপ্তরের ‘শিডিউল -১’ তালিকায় রয়েছে সোনালী বাঁদর।
আগেও ঘটেছে এই ধরনের পাচারের ঘটনা
সোনালি বাঁদর বা অন্যান্য বিদেশি প্রজাতির প্রাণী পাচারের ঘটনা নতুন নয়। গত বছর কলকাতা বিমানবন্দরে এক বিদেশি নাগরিকের লাগেজ থেকে উদ্ধার হয়েছিল একটি বিরল প্রজাতির বানরছানা। কয়েক মাস আগে ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকেও উদ্ধার করা হয়েছিল আফ্রিকান এক প্রজাতির বানর। এসব পাচারের পেছনে মূলত আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র সক্রিয়, যারা বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী পাচার করে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রাণীগুলিকে চিড়িয়াখানায় বিক্রি করা হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সংগ্রহ বা অবৈধ চিড়িয়াখানায় রাখা হয়। ভারত এই পাচারচক্রের একটি ট্রানজিট রুট হয়ে উঠছে, যা রুখতে কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে কঠোর নজরদারির প্রয়োজন।
বর্তমানে বেলডাঙা পুলিশের এই সাফল্য প্রাণী পাচার রোধে বড় পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে। ধৃতদের বিরুদ্ধে বন আইনে কড়া মামলা রুজু হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই চক্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পাচার নেটওয়ার্কের সংযোগ রয়েছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।