দায় বিদেশি ট্রলার ও রেড সাগরে হুথি হামলা
শিপিং ডেস্ক: শৈশবে সোমালির উপকূলে নিজের বাবার জালে মাছের পরিমাণ ক্রমশ কমে যেতে দেখেছিলেন আবদিকারিম ইউসুফ। বাবার দুঃখ আর হতাশা দেখে তিনি যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তেমনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের দুর্দশার জন্য দায়ী বিদেশি ট্রলারগুলো, যারা অতিমাত্রায় মাছ ধরছে সোমালির জলসীমায়।
২০০৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে আবদিকারিম সিদ্ধান্ত নেন মাছ ধরার জাল গুটিয়ে তুলে নেবেন অস্ত্র। কারণ তখন মাছ ধরেই আর জীবিকা চলছিল না। রাষ্ট্র দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত, স্থানীয় জেলেরা অসহায়। সেই বছরই তিনি যোগ দেন একদল সশস্ত্র যুবকের দলে, যারা সমুদ্রে যাচ্ছিল আর মাছ ধরতে নয়, জলদস্যু হতে।
আবদিকারিম পরে বলেন, ‘‘ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু মনে হয়েছিল আমরা ন্যায়সঙ্গত কাজ করছি। বিদেশিরা আমাদের সাগর লুটে নিচ্ছে, আমরা কেবল প্রতিশোধ নিচ্ছি।’’
পরবর্তী তিন বছর তিনি যুক্ত ছিলেন এমন এক জলদস্যু বাহিনীতে, যারা ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক রুটে আতঙ্ক ছড়ায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতি হয়। অসংখ্য নাবিক বন্দি হয়ে বছরের পর বছর অমানবিক অবস্থায় কাটান, কেউ কেউ ফিরে যাননি আর।
তবে সেই অন্ধকার দিনগুলো অনেক আগেই পেছনে ফেলেছেন আবদিকারিম। এখন তিনি গারোয়েতে বসবাস করেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। কিন্তু সতর্ক করে দেন, আবারও সোমালির জলসীমায় জলদস্যুতা বাড়ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে ধীরে ধীরে জলদস্যু হামলা বাড়ছে। ২০২৫ সালেই তিনটি জাহাজ হাইজ্যাকের শিকার হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ হাইজ্যাক হওয়া, যা মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়লা নিয়ে যাচ্ছিল। ২৩ জন নাবিককে মুক্ত করতে দিতে হয় প্রায় ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রেড সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে পশ্চিমা নৌবাহিনী সেখানে নজর দিচ্ছে বেশি, ফলে আফ্রিকার শিং অঞ্চলের সমুদ্রপথে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই ফাঁকেই সুযোগ নিচ্ছে সোমালির জলদস্যুরা।
ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক জেথরো নরম্যান বলেন, ‘‘বিদেশি ট্রলারের অবাধ মাছ ধরা বহু বছর ধরে উপকূলীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। রাষ্ট্রের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। এর সঙ্গে ক্ষোভ, সুযোগ আর অস্ত্রের যোগ মিললে জলদস্যুতার পুনর্জাগরণ অস্বাভাবিক নয়।’’
পুন্টল্যান্ডের মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রী আবদিরিজাক আবদুল্লাহ হাগা স্বীকার করেছেন, ‘‘অবৈধ মাছ ধরা শুধু পুন্টল্যান্ড নয়, পুরো সোমালির জন্য অভিশাপ। এতে স্থানীয়দের জীবিকা হুমকিতে পড়েছে, ক্ষোভ বাড়ছে।’’
তবে স্থানীয়দের কেউ কেউ এখন আর জলদস্যুদের সমর্থন করছেন না। এক সময় তারা নিজেদের ন্যায়যোদ্ধা ভাবলেও, এখন অনেকেই মনে করেন, তারা সুযোগসন্ধানী, যারা নতুন করে বিদেশি হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি করছে।
আবদিকারিম বলেন, ‘‘আমরা একসময় ভেবেছিলাম, নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াই করছি। কিন্তু আজ যারা এসব করছে, তারা কেবল অর্থলোভী। এতে সোমালির ক্ষতই আবার উন্মুক্ত হচ্ছে, আর বিশ্ব তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।’’









