Home আন্তর্জাতিক স্কুলে রক্তাক্ত বিকেল: ছাত্রের হাতে ছাত্র নিহত

স্কুলে রক্তাক্ত বিকেল: ছাত্রের হাতে ছাত্র নিহত

কিশোর সহপাঠীর হাতে ঘটে গেল ট্র্যাজেডি

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: পশ্চিম ফ্রান্সের নান্তেস শহরে অবস্থিত একটি বেসরকারি হাই স্কুলে বৃহস্পতিবার এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। মাত্র ১৫ বছর বয়সি এক ছাত্র ছুরি নিয়ে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে তারই এক সহপাঠীকে এবং গুরুতরভাবে আহত করেছে আরও তিনজনকে।

স্থানীয় পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এই মর্মান্তিক হামলা ঘটে শহরের ডৌলন এলাকার ‘নোত্র-দাম-দে-তুতেস-এইডস’ নামক বেসরকারি ক্যাথলিক হাই স্কুলে। স্থানীয় সময় দুপুর নাগাদ, হামলাকারী ছাত্রটি পরপর দুটি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে চার জন ছাত্রের ওপর ছুরি নিয়ে আক্রমণ চালায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় এক ছাত্রের। আহত তিন জন বর্তমানে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

স্কুলের সাহসী শিক্ষকরা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে হামলাকারীকে নিরস্ত্র করে ধরে ফেলেন। পরে পুলিশ এসে তাকে হেফাজতে নেয়। অভিযুক্ত ছাত্র নিজেও ওই স্কুলেরই দশম শ্রেণির ছাত্র এবং তার নামে এর আগে কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড ছিল না।

ঘটনার পরপরই পুলিশের মুখপাত্র জানান, “আমরা এখন পর্যন্ত এই হামলার পেছনে কোনো সন্ত্রাসবাদী উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত পাইনি। প্রাথমিকভাবে এটি ব্যক্তিগত বিরোধ বা মানসিক চাপে জন্ম নেওয়া আচরণ বলেই মনে হচ্ছে।”

ফরাসি সংবাদমাধ্যমগুলোও জানিয়েছে, হামলার পেছনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান কোনো ব্যক্তিগত বিবাদ বা সংঘর্ষই প্রধান কারণ হতে পারে।

এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্কুল চত্বরে ভিড় জমাতে থাকেন উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। একজন অভিভাবক, ক্লারা দুমোঁ, সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমার মেয়ে ওই স্কুলে পড়ে। সে ঘটনার সময় স্কুলেই ছিল। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না এমন কিছু এখানে ঘটতে পারে। আমরা সবাই আতঙ্কে আছি।”

আরেক অভিভাবক, জঁ-লুক মার্তাঁ বলেন, “স্কুল তো নিরাপদের জায়গা হওয়ার কথা। আমাদের সন্তানরা সেখানে গিয়ে যদি নিজের সহপাঠীর হাতেই আঘাত পায়, তবে কোথায় নিরাপদ থাকবে?”

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. এলিসা ত্রঁবলে বলেন, “এই বয়সের কিশোরদের মানসিক গঠন অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। পারিবারিক সমস্যা, স্কুলে বুলিং, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা — এগুলো সবই সহিংস আচরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের উচিত ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।”

তিনি আরও বলেন, “ফ্রান্সে স্কুল কাউন্সেলিং এখনও অনেক জায়গায় সীমিত। সরকারের উচিত জাতীয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা স্কুল পর্যায়ে শক্তিশালী করা।”

এই ঘটনার পর নান্তেস শহরের শিক্ষা দপ্তর জরুরি ভিত্তিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি, স্কুলে অতিরিক্ত নিরাপত্তা কর্মী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোতায়েন করা হয়েছে। সাময়িকভাবে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং সেশন চালু করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এই হামলার ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন সহিংসতা নয়, বরং এটি কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য, পারিবারিক পরিবেশ ও বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ে সমাজে একটি বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি-আবদ্ধ পরিবেশে কিশোররা ক্রমশ একাকী হয়ে পড়ছে, যার ফলে তারা আবেগ ও রাগের সঠিক পরিচালনা করতে পারছে না।

নান্তেসের একটি অভিভাবক সংগঠনের সদস্য মাদাম লোরান বলেন,”আমার সন্তান এই স্কুলেই পড়ে। এই ঘটনা আমাদের ভীত করে তুলেছে। আমরা চাই, স্কুলে নিরাপত্তা জোরদার হোক এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও গুরুত্ব দেওয়া হোক।”

একই রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আরও অনেক অভিভাবক। তাঁরা মনে করছেন, শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আবেগ, সম্পর্ক এবং মানসিক অবস্থা নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা ও কাউন্সেলিং প্রয়োজন।

ফরাসি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. ক্লেমেন্তিন ফেভ্রে জানান,”এই বয়সের কিশোররা মানসিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর অবস্থায় থাকে। যদি কোনও দুঃখ, রাগ বা অপমান তারা নিজের মধ্যে চেপে রাখে, তা এক সময়ে হিংসাত্মক রূপ নিতে পারে। স্কুল ও পরিবার উভয়েরই উচিত নিয়মিতভাবে তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা এবং আবেগের ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখানো।”

তিনি আরও বলেন,”সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং একাকীত্বের বোধ অনেক কিশোরকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলছে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতে আরও গুরুতর পরিণতি দেখা যেতে পারে।”