কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: বিশ্বের বাণিজ্যিক নৌবহর এক অনন্য রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালেই স্ক্র্যাপ হয়ে যেতে পারে অন্তত চার মিলিয়ন টন (গ্রস টনেজ) সমপরিমাণ জাহাজ। আর ২০২৬ সালে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বের শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিতে বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আধিপত্য এবং পরিবেশবান্ধব স্ক্র্যাপিং চুক্তি কার্যকর হওয়ার কারণে আগামী দুই বছরে পুরনো জাহাজগুলোর বিশাল অংশ কার্যত অবসরে যেতে চলেছে।
স্ক্র্যাপের ঢেউ: ২০২৫ এর পরিসংখ্যান
সামুদ্রিক বাণিজ্য ও পরিবহন বিশ্লেষক সংস্থা ‘বিমকো’র হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালেই বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে স্ক্র্যাপ হয়ে যেতে পারে প্রায় ৩.৮ থেকে ৪.২ মিলিয়ন জিটি সমপরিমাণ বাণিজ্যিক জাহাজ। এটি বিগত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। শিপইয়ার্ডে নতুন জাহাজের ডেলিভারি বৃদ্ধির ফলে পুরনো জাহাজের বাজারে চাহিদা কমে যাচ্ছে, ফলে অনেক জাহাজ মালিক আগেভাগেই স্ক্র্যাপের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ—ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান—বিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ জাহাজ স্ক্র্যাপিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী, সীতাকুণ্ড উপকূলে প্রায় শতাধিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ড এই কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
২০২৬ সালে আরও জোরালো প্রবণতা
২০২৬ সাল আরও বড় স্ক্র্যাপের বছর হতে পারে। কারণ, কন্টেইনার, গাড়িবাহী ও এলএনজি ট্যাংকারসহ অনেক পুরনো জাহাজ ২০ বছরের মেয়াদ পেরিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৬ সালে স্ক্র্যাপ হতে পারে অন্তত ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন জিটি সমপরিমাণ জাহাজ। অনেক বড় জাহাজ কোম্পানি পরিবেশ সুরক্ষায় হংকং কনভেনশন অনুযায়ী পুরনো জাহাজ সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। ২০২৫ সালের জুন থেকে এই চুক্তি কার্যকর হবে, ফলে স্ক্র্যাপের গতি আরও বাড়বে।
বর্তমান সচল বহরের চিত্র
২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সক্রিয় বাণিজ্যিক জাহাজ বহরের মোট সংখ্যা প্রায় এক লাখ ছয় হাজার ইউনিট। এর মধ্যে বাল্ক ক্যারিয়ার প্রায় ১৩ হাজার, তেলবাহী ট্যাংকার ১২ হাজার এবং কনটেইনারবাহী জাহাজ প্রায় ছয় হাজারের মতো। মোট ডেডওয়েট টনেজ বা DWT প্রায় ২.৪ বিলিয়নের কাছাকাছি।
শুধু ২০২৫ সালেই বাল্ক ক্যারিয়ার ক্লাসে ৫০০টির বেশি নতুন জাহাজ বাজারে আসবে, যার প্রভাব পড়বে পুরনো জাহাজগুলোর ওপর। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুরনো জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাড়ার পাশাপাশি বিমা ও নৌনিরাপত্তা সংক্রান্ত চাপের কারণে স্ক্র্যাপ ছাড়া বিকল্প থাকবে না।
এক টনে কত দাম?
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম চলছে গড়ে ৫০০ থেকে ৫৮০ মার্কিন ডলার প্রতি টন। তবে এটি দেশের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে এটি ৫৫০ ডলার পর্যন্ত উঠছে। স্ক্র্যাপযোগ্য জাহাজের ওজন যদি ১৫ হাজার টন হয়, তবে একটি জাহাজ থেকে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।
পরিবেশ ও নিরাপত্তার দিক
হংকং কনভেনশন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৬ জুনের পর থেকে জাহাজ স্ক্র্যাপিংয়ে নির্দিষ্ট মানদণ্ড ও পরিবেশগত নিরাপত্তা বজায় রাখা বাধ্যতামূলক। তাতে অদক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্ক্র্যাপিং কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ব্যবস্থাপনা তৈরি হবে।
শেষ কথা
বিশ্ব জাহাজ শিল্পে এক নীরব বিপ্লব চলছে। নতুন প্রযুক্তিনির্ভর জাহাজ যেমন বাজার দখল করছে, তেমনি পুরনো জাহাজগুলো চলে যাচ্ছে স্ক্র্যাপে। ২০২৫ ও ২০২৬ সাল হতে চলেছে এই রূপান্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বছর। পরিবেশ, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা—তিনটি বিষয়কে একত্রে বিবেচনায় নিয়েই এগোচ্ছে বিশ্ব জাহাজশিল্পের ভবিষ্যৎ।
🔔 আপডেটেড থাকুন!
শিপিং, ব্যবসা ও শিল্প সংশ্লিষ্ট আরও বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন পেতে চোখ রাখুন বিজনেসটুডে২৪.কম -এ।