আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) স্বর্ণের চাহিদা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশ্ব স্বর্ণ পরিষদের (ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের চাহিদা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ শতাংশ বেড়ে ১,৩১৩ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ত্রৈমাসিক চাহিদা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়াই এই রেকর্ড বৃদ্ধির মূল কারণ। নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণীয়তার কারণে ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত স্পট স্বর্ণের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২০ অক্টোবর প্রতি ট্রয় আউন্স স্বর্ণের দাম ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪,৩৮১ মার্কিন ডলারে পৌঁছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে “ফিয়ার অব মিসিং আউট” বা হারানোর ভীতি আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ঘিরে অনিশ্চয়তা এবং বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের স্বর্ণের দিকে ঝুঁকতে উৎসাহিত করছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের সিনিয়র মার্কেট বিশ্লেষক লুইস স্ট্রিট বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে স্বর্ণের বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “স্বর্ণের বাজারে এই ইতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। কারণ, ডলারের দুর্বলতা, সুদের হার হ্রাসের সম্ভাবনা এবং স্থবির মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বিনিয়োগের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।” স্ট্রিট আরও যোগ করেন, “আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাজার এখনও পূর্ণ নয়, এখনও বৃদ্ধির সুযোগ আছে।”
বিনিয়োগে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি, গহনার চাহিদা হ্রাস
প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৃতীয় প্রান্তিকে স্বর্ণবার ও স্বর্ণমুদ্রায় বিনিয়োগ ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত শারীরিক স্বর্ণনির্ভর এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে বিনিয়োগের প্রবাহ ১৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের স্বর্ণের প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থা প্রতিফলিত করে।
তবে, ঐতিহ্যগতভাবে শারীরিক স্বর্ণের সবচেয়ে বড় খাত, স্বর্ণালংকারের চাহিদা এর বিপরীত চিত্র দেখিয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা ক্রয় কমিয়ে দেওয়ায় স্বর্ণালংকারের চাহিদা ২৩ শতাংশ কমে ৪১৯.২ টনে নেমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রেকর্ড ক্রয় ও সরবরাহ বৃদ্ধি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও তাদের স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়াতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তৃতীয় প্রান্তিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি, অর্থাৎ ২১৯.৯ টন স্বর্ণ ক্রয় করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মোট ৬৩৪ টন স্বর্ণ কিনেছে, যা ২০২২ সালের আগের গড়ের চেয়ে অনেক বেশি, যদিও গত তিন বছরের রেকর্ড পরিমাণ ক্রয়ের নিচে।
সরবরাহের দিক থেকেও ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। তৃতীয় প্রান্তিকে পুনর্ব্যবহার ৬ শতাংশ এবং খনি উৎপাদন ২ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলস্বরূপ, মোট বৈশ্বিক স্বর্ণ সরবরাহও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল জানিয়েছে। এই সামগ্রিক চিত্র ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশে অনিশ্চয়তা যতদিন থাকবে, ততদিন স্বর্ণের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ অব্যাহত থাকবে।










