বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল ( মৌলভীবাজার): শ্রীমঙ্গল উপজেলার হরিণছড়া চা বাগানের চম্পাতলি লেবার লাইনে একটি সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে পড়ে যাওয়া মোবাইল ফোন তুলতে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের বিষক্রিয়ায় চার যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় একজনকে চিকিৎসার জন্য সিলেট পাঠানো হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাগানের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ওই লেবার লাইনে মোবাইল ফোনটি ট্যাংকের ভেতরে পড়ে গেলে এক যুবক তা তুলতে নেমে যান। নিচে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষাক্ত গ্যাসের কারণে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে উদ্ধার করতে একে একে তিনজন নামেন, কিন্তু কেউই আর জীবিত ফিরে আসেননি। অজ্ঞাতে মৃত্যুর ফাঁদে পা দিয়েই একে একে সবাই প্রাণ হারান।
নিহতরা হলেন—রানা নায়েক (১৭), শ্রাবণ নায়েক (১৯), কৃষ্ণ রবিদাস (২০) এবং নিপেন ফুলমালি (২৭)। আহত রবি বুনার্জী (২০)-কে আশঙ্কাজনক অবস্থায় শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। প্রত্যেকেই হরিণছড়া চা বাগানের বাসিন্দা এবং চা শ্রমিক পরিবারের সদস্য।
চিকিৎসক ডা. সব্যসাচী পাল তমাল জানান, “রাতে আমাদের কাছে যাদের আনা হয়, তারা সবাই মৃত ছিলেন। বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুর প্রাথমিক ধারণা করছি। ময়নাতদন্তের পর চূড়ান্ত তথ্য জানা যাবে।”
শ্রীমঙ্গল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তা করে। মরদেহ হাসপাতালেই রয়েছে, প্রক্রিয়া শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।”
চা শ্রমিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। একই পরিবারের দুই ভাইসহ চার তরুণের এমন অকাল মৃত্যুতে গোটা এলাকা স্তব্ধ হয়ে গেছে। হৃদয়বিদারক এই ঘটনার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং শোকাহত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানান।
স্থানীয়দের অনেকে অভিযোগ করেন, বাগানে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাঁরা এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।
কেন ঘটে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু?
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায়। সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে থাকে হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন, অ্যামোনিয়া জাতীয় বিষাক্ত গ্যাস। এদের মাত্রা বেশি হলে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। অথচ অপ্রশিক্ষিত শ্রমিক, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ কিংবা সুরক্ষা গিয়ার ছাড়াই পাঠানো হয় নিচে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেপটিক ট্যাংকে কাজের আগে নিয়ম করে গ্যাস পরীক্ষা, পর্যাপ্ত বায়ুচলাচল, মাস্ক ও প্রটেকটিভ গিয়ার ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না।
এক গ্রামের চারটি লাশ
হরিণছড়ার এই বাগানপাড়ায় এখন কেবল কান্নার রোল। দরিদ্র চা শ্রমিক পরিবারগুলো হারিয়েছে তাদের ছেলেকে—যারা হয়তো ঘরে চাল তুলে দেওয়ার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিতে গিয়েছিল। অথচ যদি একটু সচেতনতা থাকত, একটু নিরাপত্তা থাকত—এই অকাল মৃত্যু হয়তো ঠেকানো যেত।