Home স্বাস্থ্য হাইপারথাইরয়েডিজম: অতিসক্রিয় থাইরয়েড গ্রন্থির নিঃশব্দ হুমকি

হাইপারথাইরয়েডিজম: অতিসক্রিয় থাইরয়েড গ্রন্থির নিঃশব্দ হুমকি

হেলথ ডেস্ক: চোখের পাতা কাঁপছে, হৃদস্পন্দন বাড়ছে, ঘুম ঠিক হচ্ছে না, হঠাৎ করে ওজন কমে যাচ্ছে—অনেকেই ভাবেন এটা মানসিক উদ্বেগ, স্ট্রেস কিংবা জীবনযাত্রার চাপে স্বাভাবিক ব্যাপার। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, এসব উপসর্গ হাইপারথাইরয়েডিজমের—একটি নীরব অথচ মারাত্মক থাইরয়েড রোগ—সরাসরি ইঙ্গিত।

কী এই হাইপারথাইরয়েডিজম?

হাইপারথাইরয়েডিজম হল এমন একটি শারীরবৃত্তীয় অবস্থা, যখন মানুষের গলার সামনে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হারে থাইরয়েড হরমোন (ট্রাইআইওডোথাইরোনিন বা T3 ও থাইরোক্সিন বা T4) উৎপন্ন করে। এর ফলে দেহের বিপাক প্রক্রিয়া (Metabolism) মাত্রাতিরিক্ত গতিতে চলে এবং সৃষ্টি করে নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতা।

উপসর্গ যেগুলো অনেকেই অবহেলা করেন

  • দ্রুত বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
  • অতিরিক্ত ঘাম ও গরমে অস্বস্তি
  • ওজন হ্রাস, তবে খিদে বেড়ে যাওয়া
  • অনিদ্রা ও উদ্বেগ
  • হাত কাঁপা, পেশিতে দুর্বলতা
  • গলার সামনের অংশে ফুলে যাওয়া (গয়টর)
  • মাসিক অনিয়ম বা বন্ধ হয়ে যাওয়া
  • চোখ বড় হয়ে যাওয়া বা বের হয়ে আসা (বিশেষত গ্রেভস ডিজিজে)

প্রধান কারণ: গ্রেভস ডিজিজ

বিশ্বজুড়ে হাইপারথাইরয়েডিজম রোগীদের প্রায় ৬০–৭০ শতাংশের কারণ গ্রেভস ডিজিজ। এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভুল করে থাইরয়েড গ্রন্থিকে অতিরিক্ত সক্রিয় করে তোলে।
গ্রেভস ডিজিজে আক্রান্তদের অনেকের চোখে প্রদাহ দেখা দেয়, যা “থাইরয়েড আই ডিজিজ” নামে পরিচিত। ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, এসব রোগীকে রেডিও আইডিন থেরাপি দেওয়ার আগে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

নির্ণয় ও পরীক্ষাগুলি

হাইপারথাইরয়েডিজম শনাক্ত করতে নিচের পরীক্ষাগুলি সাধারণত করা হয়:

TSH (Thyroid Stimulating Hormone): এই হরমোন হাইপারথাইরয়েডিজমে অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়।

T3 ও T4: এই দুই হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়।

Thyroid Antibodies Test: গ্রেভস ডিজিজ শনাক্তে সাহায্য করে।

  • আল্ট্রাসাউন্ড ও রেডিওআইডিন আপটেক স্ক্যান: থাইরয়েড গ্রন্থির গঠন ও কার্যকারিতা জানতে ব্যবহৃত হয়।
  • চিকিৎসার পদ্ধতি: একাধিক পথ
  • ১. অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ
  • মেথিমাজোল ও প্রোপাইলথায়োরাসিল (PTU): থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন কমায়।
  • দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে—যেমন রক্তে শ্বেত কণিকার ঘাটতি।
  • ২. বেটা-ব্লকার
  • প্রোপ্রানলল বা এটেনোলল ব্যবহার করা হয় হৃদস্পন্দন ও কম্পন নিয়ন্ত্রণে।
  • রেডিওআইডিন থেরাপি (RAI)
  • মুখে খাওয়ানো একটি তেজস্ক্রিয় আয়োডিন ক্যাপসুল যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে ধ্বংস করে দেয়।
  • তবে থাইরয়েড আই ডিজিজ থাকলে এই চিকিৎসা খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
  • অস্ত্রোপচার (থাইরয়েডেকটমি)
  • যখন ওষুধ বা RAI কাজ করে না, অথবা গ্রন্থি অত্যন্ত বড় হয়ে যায়।
  • নতুন নির্দেশনা: কী বলছে গবেষণা?
  • ২০২৫ সালে Endocrinology and Metabolism জার্নালে প্রকাশিত নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধই এখন অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পছন্দ হিসেবে বিবেচিত।
    রেডিওআইডিন থেরাপি বা অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর চোখ, হাড়, হৃদপিণ্ড—সব দিক বিবেচনা করে চিকিৎসা পরিকল্পনা করতে বলা হয়েছে।
  • জটিলতা: অবহেলার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ
  • থাইরয়েড স্টর্ম: হঠাৎ হরমোন প্রবাহ বৃদ্ধিতে জ্বর, দ্রুত হৃদস্পন্দন, বিভ্রান্তি ও মৃত্যুঝুঁকি।
  • অস্থির হৃদযন্ত্র: অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনসহ হৃদরোগের আশঙ্কা।
  • হাড় ক্ষয়: দীর্ঘমেয়াদি হাইপারথাইরয়েডিজমে অস্টিওপোরোসিস হতে পারে।
  • কী করণীয়?
  • হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, অস্থিরতা, ঘুমহীনতা, হৃদস্পন্দনে অনিয়ম দেখা দিলে দ্রুত থাইরয়েড টেস্ট করুন।
  • সঠিক চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ বন্ধ বা পরিবর্তন করবেন না।
  • দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা হলেও নিরুৎসাহিত হবেন না—সঠিক চিকিৎসায় সুস্থ থাকা সম্ভব।
  • গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।

 

  • হাইপারথাইরয়েডিজম এমন একটি রোগ, যা শরীর ও মনের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। উপসর্গগুলোকে অবহেলা না করে সময়মতো পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক নির্ণয় ও চিকিৎসা নিলেই এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সুস্থ থাকার চাবিকাঠি সচেতনতা ও সময়মতো সাড়া দেওয়া।