বিজেনসটুডে২৪ প্রতিনিধি, হাটহাজারী ( চট্টগ্রাম ): হালদা নদী আবারও প্রমাণ দিল এটাই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, নদীতেই রুইজাতীয় মা-মাছ স্বাভাবিক পরিবেশে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শুরু হয়ে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত চলে এই ডিম ছাড়ার মহোৎসব। বৈরী আবহাওয়ার মাঝেও এবার রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় আট গুণ বেশি।
নদীর দুই পাড়ে যেন এক উৎসবের রূপ নেয়। মদুনাঘাট, আজিমের ঘাট, আমতুয়া, রামদাশ মুন্সিরহাট, মাচুয়া গোনা, কাগতিয়া ও কেরামতালি সব জায়গায় দেখা যায় উৎসাহী মাছচাষি ও স্থানীয় সংগ্রহকারীদের ভিড়। প্রায় ২৫০টি নৌকায় ৫৫০ জনেরও বেশি ডিম সংগ্রাহক দলবদ্ধভাবে অংশ নেন। এবার প্রায় ১৪ হাজার কেজি নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো পরবর্তীতে হ্যাচারিতে রেণু হিসেবে রূপান্তরিত হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “এই বছর হালদার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টেই মা-মাছ ডিম ছেড়েছে। এমন বিস্তৃত এলাকায় ডিম সংগ্রহের নজির সাম্প্রতিক কালে খুব কমই দেখা গেছে।”
রাউজান উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন আজাদী জানান, “আবহাওয়ার সহায়তা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে এবারের ডিম সংগ্রহ একটি ব্যতিক্রমী সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতো বিপুল পরিমাণ ডিম ভবিষ্যতে মাছ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
প্রবীণ সংগ্রহকারী উদয়ন বড়ুয়া বলেন, “৩৫ বছর ধরে নদীতে কাজ করছি। কিন্তু এমন পরিমাণ ডিম শেষ কবে পেয়েছি, মনে করতে পারছি না। কষ্টের ফল এবার স্বর্ণের মতো।” একইসঙ্গে মো. সোহেল, মো. হাসানসহ অনেকেই জানিয়েছেন, তারা পাঁচ-ছয়টি নৌকার মাধ্যমে ২০ থেকে ৩০ বালতি ডিম সংগ্রহে সক্ষম হয়েছেন।
নদীতে ডিম ছাড়ার সময় ও স্থান চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক ড. শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, “জোয়ারের সময় মা-মাছেরা আমতুয়া পয়েন্টে ডিম ছেড়েছে। যারা আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে নৌকা নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন, তারাই সবচেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহ করেছেন।”
উল্লেখযোগ্যভাবে, হালদা নদীতে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। চলতি বছর সেই রেকর্ড স্পর্শ না করলেও ১৪ হাজার কেজির বেশি সংগ্রহ গবেষকদের মতে ‘খুবই সন্তোষজনক’।
বর্তমানে নদীর পাড়ে সরকারি ও ব্যক্তিগত হ্যাচারিগুলোতে পুরোদমে চলছে রেণু উৎপাদনের প্রক্রিয়া। নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ডিম সংগ্রহে সহযোগিতার জন্য মাঠে রয়েছে নৌ পুলিশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত দল।
হালদা নদী: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশে কেবলমাত্র হালদা নদীতেই স্বাভাবিক পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ প্রজাতির মা-মাছ ডিম ছাড়ে। বিশ্বের অন্যান্য নদীর মতো কৃত্রিম হ্যাচারির প্রয়োজন নেই এখানে। তাই ‘সাদা সোনা’ খ্যাত এই নিষিক্ত ডিম শুধু স্থানীয় চাষিদেরই নয়, দেশের মৎস্যখাতের ভবিষ্যতের অন্যতম ভরসা।
👉 আপনিও কি হালদা নদীর এই প্রাকৃতিক বিস্ময় প্রত্যক্ষ করেছেন? নিচে মন্তব্য করুন আপনার অভিজ্ঞতা। আরও এমন প্রতিবেদন পেতে চোখ রাখুন বিজনেসটুডে২৪.কম–এ। পরিবেশ, নদী ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন পড়তে ভিজিট করুন প্রতিদিন!