তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: হিমালয়ের হাড়কাঁপানো শীত আর তুষারপাত যখন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন খাদ্যের সন্ধানে সমতলের দিকে ডানা মেলে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পাখি ‘হিমালয়ান গ্রিফন ভলচার’ বা ‘হিমালয় গৃধিনী শকুন’। প্রতি বছর শীতকালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এদের দেখা মেলে। তবে আনন্দের বিষয় হলো, এরা আমাদের অতিথি হয়ে এলেও, বেদনার বিষয় হলো, প্রায়ই এরা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে লোকালয়ে ধরা পড়ছে।
সম্প্রতি মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে দেশের দুটি ভিন্ন জেলায় কুড়িগ্রাম ও সিরাজগঞ্জে, দুটি বিশাল আকৃতির শকুন উদ্ধারের ঘটনা পরিবেশবিদ ও সাধারণ মানুষের মনে কৌতূহল জাগিয়েছে। কেন এই শকুনগুলো বারবার লোকালয়ে এসে পড়ছে?
সাম্প্রতিক উদ্ধার: সিরাজগঞ্জ
সর্বশেষ রবিবার বিকেলে সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের আমলাপাড়া মহল্লা থেকে একটি অসুস্থ হিমালয় গৃধিনী শকুন উদ্ধার করা হয়। যমুনা নদীর চরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকা এই শকুনটিকে প্রথমে স্থানীয়রা এবং পরে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘দি বার্ড সেফটি হাউজ’ উদ্ধার করে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এটি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে ওড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।
কুড়িগ্রাম
এর ঠিক ৯ দিন আগে, গত ৫ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার উমরমজিদ ইউনিয়নের একটি গ্রাম থেকে আরও একটি হিমালয়ান গৃধিনী উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় শিশুরা বিশাল এই পাখিটিকে দেখতে পেয়ে ধাওয়া দিলে সেটি একটি বাঁশঝাড়ে আটকা পড়ে। পরে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের সহায়তায় সেটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
কেন এই শকুনগুলো বাংলাদেশে আসছে?
হিমালয় গৃধিনী মূলত তিব্বত মালভূমি ও হিমালয় পর্বতমালার বাসিন্দা। শীতকালে (নভেম্বর থেকে মার্চ) হিমালয়ের উপরিভাগ বরফে ঢেকে যায়। ফলে সেখানে মৃত গবাদিপশু বা প্রাণীর দেহাবশেষ (যা এদের প্রধান খাদ্য) খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া তীব্র শীতে টিকে থাকাও কষ্টকর হয়।
তাই বেঁচে থাকার তাগিদে এবং খাদ্যের সন্ধানে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এরা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে (যেমন—কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ) চলে আসে। বাংলাদেশ বা ভারতের সমতল ভূমি তাদের জন্য এই সময় তুলনামূলক উষ্ণ এবং সহনীয়।
লোকালয়ে কেন ধরা পড়ছে বা অসুস্থ হচ্ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, উদ্ধার হওয়া শকুনগুলোর অধিকাংশই ‘জুভেনাইল’ বা অল্প বয়সী। এদের অসুস্থ হয়ে পড়ার পেছনে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে:
১. উড্ডয়ন ক্লান্তি ও খাদ্যাভাব: হিমালয় থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিতে গিয়ে এদের প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। যাত্রাপথে পর্যাপ্ত খাবার না পেলে এরা দুর্বল হয়ে পড়ে।
২. থার্মাল বা উষ্ণ বাতাসের অভাব: শকুন অনেক ভারী পাখি। এরা ডানা ঝাপটে বেশিক্ষণ উড়তে পারে না; ওড়ার জন্য এরা বাতাসের উষ্ণ প্রবাহ বা ‘থার্মাল’ ব্যবহার করে ভেসে থাকে। শীতকালে বাংলাদেশে ঘন কুয়াশা ও আকাশ মেঘলা থাকলে এই ‘থার্মাল’ তৈরি হয় না। ফলে শকুনদের ডানা ঝাপটে উড়তে হয়, যা তাদের দ্রুত ক্লান্ত করে মাটিতে ফেলে দেয়।
৩. অনভিজ্ঞতা: কম বয়সী শকুনগুলো তাদের প্রথম পরিযায়নে অনেক সময় দলের সাথে তাল মেলাতে পারে না বা পথ হারিয়ে ফেলে।
হিমালয় গৃধিনী: এক নজরে
নাম: হিমালয়ান গ্রিফন ভলচার ।
আকৃতি: এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শকুন। এদের ডানার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯-১০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।
খাদ্য: এরা সম্পূর্ণ মৃতভোজী। মৃত গরু, মহিষ বা অন্য প্রাণীর মাংস খেয়ে এরা পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখে।
গুরুত্ব: শকুনকে বলা হয় ‘প্রকৃতির মেথর’। এরা অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মাসহ প্রায় ৪০টি মারণ রোগের জীবাণু হজম করতে পারে, যা অন্য কোনো প্রাণী পারে না। শকুন না থাকলে মৃতদেহ পচে রোগবালাই ছড়িয়ে মহামারী সৃষ্টি হতো।
বর্তমান অবস্থা ও আমাদের করণীয়
আইইউসিএন-এর লাল তালিকা অনুযায়ী হিমালয় গৃধিনী ‘প্রায় বিপদগ্রস্ত’ প্রজাতির। তবে বাংলাদেশে স্থায়ী শকুন (বাংলা শকুন) আজ ‘মহাবিপন্ন’।
সিরাজগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই বিশাল ডানাওয়ালা মেহমানরা আমাদের পরিবেশের বন্ধু। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘দি বার্ড সেফটি হাউজ’-এর চেয়ারম্যান মামুন বিশ্বাস এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন অসুস্থ শকুনগুলোকে সুস্থ করে পুনরায় প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে।
কোথাও এমন অসুস্থ শকুন দেখলে তাকে বিরক্ত বা আঘাত না করে স্থানীয় বন বিভাগ বা প্রাণিসম্পদ অফিসে খবর দেওয়া আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। কারণ, প্রকৃতির এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বাঁচলেই আমাদের পরিবেশ সুস্থ থাকবে।










