এমরান মাহমুদ প্রত্যয়, আত্রাই (নওগাঁ): ধূমপানের আরেক নাম ছিল ‘হুক্কা’। কখনও এটি ছিল আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু, কখনও প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতীক। কিন্তু আবহমান বাংলার সেই ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
বাংলার লোকসংগীত ও ছড়ায় অমর হয়ে আছে হুক্কা। ‘আমার মান কুল মান সব হারাইলাম, এই হুক্কার সঙ্গ ধরে রে…’ কিংবা রম্য ছড়া ‘হায়রে সে-ই হুক্কা, উপরে তার তামাক-কলকি, নিচের দিকে চুক্কা…’—এসব গান ও ছড়ার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে হুক্কার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। অথচ বাস্তবে বস্তুটি এখন প্রজন্মের কাছে প্রায় অপরিচিত। শহরে তো বটেই, গ্রামেও আর হুক্কার দেখা মেলে না।
তিন-চার দশক আগেও বাংলার গ্রামগঞ্জে ধূমপায়ীদের কাছে হুক্কা ছিল অপরিহার্য। সামাজিক অনুষ্ঠান, গ্রাম্য সালিশ কিংবা বিকালের আড্ডায় ছোটবড় সবারই আপ্যায়নে ব্যবহৃত হতো হুক্কা। বিশেষ করে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর বাড়িতে লম্বা পাইপযুক্ত স্ট্যান্ড হুক্কা ছিল মর্যাদা ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। সেই দিনগুলোর হুক্কা আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
এখনকার প্রজন্মের কাছে হুক্কা শুধুই গল্পে শোনা এক ঐতিহ্য। এর জায়গা দখল করেছে সিগারেট, বিড়ি কিংবা আরও ক্ষতিকর নেশাজাত দ্রব্য। অথচ বিশেষভাবে তৈরি হুক্কার তামাকে নিকোটিনের পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। প্রবীণদের মতে, হুক্কা যদি টিকে থাকত, তাহলে অনেক তরুণ হয়তো সিগারেট কিংবা মারাত্মক মাদকের নেশায় জড়াত না।
সম্প্রতি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সাহাগোলা ইউনিয়নের এক গ্রামে গেলে দেখা যায়, প্রবীণ কয়েকজন এখনও ধূমপান করেন, তবে হুক্কার ব্যবহার আর নেই। নারায়ণ চন্দ্র নামে এক বৃদ্ধ স্মৃতিচারণ করে বলেন,
“আমাদের দাদাদের সময়ে হুক্কার আসর জমত। বিকেলে সবাই মিলে আড্ডা দিত। তখন খাবারের চেয়ে হুক্কার নেশাই ছিল বড়। ঘরে চাল না থাকলেও তামাক অবশ্যই থাকত। তামাকপাতা টুকরো করে চিটাগুড় মিশিয়ে বানানো হতো বিশেষ তামুক। সেই তামাকে নিকোটিনের পরিমাণ কম থাকত, আর নারকেলের টোলে থাকা পানিতে অনেকটা নিকোটিন শোষিত হয়ে যেত।”
তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, “বাপদাদার ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। হুক্কার স্থান দখল করেছে সিগারেট, বিড়ি আর পান।”
বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হুক্কা কেবল ধূমপানের মাধ্যম ছিল না; এটি ছিল মিলনমেলা, আন্তরিকতার প্রতীক। আজ সেটি হারিয়ে গিয়ে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য আরও এক ধাপ পিছিয়ে পড়েছে।