Home Second Lead গহিরা: মৃত্যু আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের জীবন্ত ইতিহাস

গহিরা: মৃত্যু আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের জীবন্ত ইতিহাস

সংগৃহীত ছবি
বিশেষ প্রতিনিধি, বিজনেসটুডে২৪
গহিরা ( আনোয়ারা ) চট্টগ্রাম: আজ ২৯ এপ্রিল। গহিরার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে নিঃশব্দ এক কান্নায়।
ঠিক ৩৪ বছর আগে, ১৯৯১ সালের এই রাতেই উপকূলীয় এই গ্রামটিতে নেমে এসেছিল মৃত্যুর ঝড়। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস যেন মুছে দিয়েছিল সবকিছু—ঘরবাড়ি, গাছপালা, প্রিয়জন, জীবনের স্বপ্ন।
আজও সেই রাতের কথা মনে পড়লে গহিরার মানুষের চোখে অশ্রু জমে। সঠিক হিসাব মেলেনি আজও—কতজন হারিয়ে গিয়েছিল চিরতরে।
তখন ছিল ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। কিন্তু বহুবার এরকম সংকেতের অভিজ্ঞতায় মানুষ গুরুত্ব দেয়নি পূর্বাভাসকে। টেলিভিশন তখন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেনি। খবরের একমাত্র ভরসা ছিল রেডিও আর শহর থেকে ফেরা কোনো সংবাদপত্র। গহিরায় ছিল একটি মাত্র ভিএইচএফ টেলিফোন, দোভাষীর হাটে। ব্যয়বহুল সেই টেলিফোনের মাধ্যমে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যেত। সেখানে তখন কর্মরত ছিলেন বাঁশখালীল দিদারুল আলম।
চট্টগ্রামের সাংবাদিক কামরুল ইসলাম তখন কাজ করতেন রাজধানীভিত্তিক জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্র ‘খবর’-এ।
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেদিন রাতে ভিএইচএফ টেলিফোন কেন্দ্রে দিদারুল আলমকে ফোনে পরিস্থিতি জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানালেন, মানুষ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেউ আড্ডায় মশগুল, কেউ গল্পে, কেউ তাস খেলায় । দিদার আশঙ্কা করেছিলেন—’সত্যি যদি দুর্যোগ আসে, তাহলে এখানে অসংখ্য প্রাণহানি হবে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দিদারের সেই ভয়াবহ আশঙ্কা নির্মম বাস্তবে রূপ নেয়।
রাতের তাণ্ডব: বঙ্গোপসাগরের বিশাল ঢেউ তখন গ্রাম গহিরাকে গ্রাস করেছিল। টেকসই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না—ছিল শুধু একটি জরাজীর্ণ কমিউনিটি সেন্টার, দুটি স্কুল ভবন, কয়েকটি মসজিদ আর কিছু ব্যক্তিগত পাকাবাড়ি। এসব ভবন এতই দুর্বল ছিল যে, এক মসজিদে আশ্রয় নেয়া ৩৪ জন মানুষ মসজিদের ছাদ ভেঙে চাপা পড়ে মারা যান। মো. আলী (৭২) স্মৃতিচারণ করে বলেন: “তালগাছ ধরে তিন ঘণ্টা ভেসেছিলাম। চারদিকে শুধু মৃতদেহ। ঢেউয়ের শব্দ শুনলে আজও বুক কাঁপে।”

রওশন (৬৫) বলেন: “ছোট ছেলেকে বাঁচাতে পারিনি। হাতে ছিল, পানির তোড়ে হারিয়ে গেল। সেই কান্না আজও থামেনি।”

আব্দুল করিম (৭৮) কাঁদতে কাঁদতে বলেন: “এক হাতে মা, এক হাতে ছেলে। কাউকেই রাখতে পারিনি। আমি কেন বেঁচে গেলাম, জানি না।”

ন্যূনতম বস্ত্রও রক্ষা হয়নি: সেই রাতের জলোচ্ছ্বাস শুধু ঘর-বাড়ি ভাসায়নি, মানুষকে করেছে সর্বস্বান্ত।
অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়ে দৌঁড়ে আশ্রয় নিতে গিয়ে কেবল পরণের একটি লুঙ্গি বা শাড়ি নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কেউ কেউ সেটুকুও রক্ষা করতে পারেননি। জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে বহু নারী বে-আব্রু হয়েছিলেন। রক্তাক্ত হয়েছিল নারী-মানবতার মর্যাদা।

নুরুন (৭০) কাঁপা গলায় বলেন: “সব হারাইছি। একটা কাপড় পর্যন্ত ছিল না গায়ে। লোকজন যা দিছে পরে বেঁচেছিলাম।”

সালেহা খাতুন (৬৮) বলেন: “জলোচ্ছ্বাসের পানির সাথে যুদ্ধ করছি, গায়ের কাপড়ও ধইরা রাখতে পারি নাই। এ জীবন আর জীবন না।”

নতুন গহিরা, পুরনো কান্না: বর্তমানে গহিরায় গড়ে উঠেছে আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র, বেড়েছে দুর্যোগ সচেতনতা।
স্থানীয় একজন সাবেক জনপ্রতিনিধি মো. জানে আলম বলেন, ১৯৯১ সালের মতো বিপর্যয়আসলে তা তো ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই। তবে, সেবারের মত ক্ষয় ক্ষতি যাতে না হয় সেই চেষ্টা করেছি।
নতুন নতুন দালান-কাঠামো গড়ে উঠেছে, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে গহিরায়। কিন্তু সেই হারানোর যন্ত্রণা এখনো মুছে যায়নি। আজও গ্রামের বাতাসে ভেসে বেড়ায় ১৯৯১ সালের সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি। মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান—যাদের হারিয়েছে, তাদের কথা মনে করে মানুষ এখনো কাঁদে।
যারা সেদিন বেঁচে গিয়েছিল, তারা আজও বুকের ভেতর চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছেন। তাদের জীবনের গল্প, তাদের বেদনা আর স্মৃতিই হয়ে উঠেছে গহিরার জীবন্ত ইতিহাস।