মোস্তফা তারেক, নিউইয়র্ক:নিউইয়র্কের ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউয়ের ৪৪ তলা ভবনে ভয়াবহ গুলিবর্ষণের ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল আলম ( বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত) সহ মোট চারজন নিহত হওয়ার পর তদন্তকারীদের সামনে এক গভীর প্রশ্ন উঠে এসেছে কে এই শেইন তামুরা? কীভাবে একজন তরুণ, যার অস্ত্র বহনের লাইসেন্স ছিল এবং যিনি মানসিক সমস্যার কথাও কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তিনি নিউইয়র্ক শহরের সবচেয়ে সুরক্ষিত ভবনগুলোর একটিতে ঢুকে রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড চালাতে পারলেন?
২৭ বছর বয়সী তামুরা লাস ভেগাসে হর্সশু ক্যাসিনোতে কাজ করতেন। নিরীহ স্বভাবের, কিছুটা অন্তর্মুখী, কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন বলে জানা গেছে। তবে পুলিশ বলছে, তার মানসিক অবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই অস্বাভাবিক ছিল এবং তিনি নিজেই তা স্বীকার করেছিলেন।
২০২২ সালে তিনি বন্দুক বহনের লাইসেন্স নেন। কিছু সময় পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকার কথা পুলিশের কাছে জানান। তবুও তার লাইসেন্স বজায় ছিল। এটাই এখন তদন্তকারীদের অন্যতম উদ্বেগের জায়গা।
‘আমার মাথা ভেঙে যাচ্ছে’: মানিব্যাগে পাওয়া চিঠি
তামুরার মানিব্যাগ থেকে উদ্ধার হওয়া হাতে লেখা চিঠিগুলোতে ছিল অসংলগ্ন বক্তব্য, চিকিৎসার আকুতি আর নিজের অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা। সেখানে লেখা ছিল, তিনি ‘সিটিই’ নামক এক স্নায়ুবিক রোগে আক্রান্ত। এ রোগ সাধারণত সেইসব মানুষের মধ্যে দেখা যায়, যাদের মাথায় বারবার আঘাত লেগেছে—বিশেষ করে আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে।
চিঠিতে তিনি ফুটবল খেলাকে দায়ী করেছেন নিজের বর্তমান মানসিক অবস্থার জন্য। এমনকি মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক গবেষণার জন্য দিয়ে যাওয়ার অনুরোধও রেখে গেছেন। তার ভাষায়, “আমার মাথার ভেতরে সবকিছু ঘুরছে। আমি বোঝাতে পারছি না, কিন্তু প্রতিটি শব্দ কানে টান মারে। আমি শান্তি চাই।”

কীভাবে তৈরি হলো তামুরার অস্ত্র
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, তামুরার হাতে থাকা অস্ত্র ছিল একটি এআর-১৫ রাইফেল, যা তিনি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে নিজেই তৈরি করেছিলেন। এর লোয়ার রিসিভার নামক অংশটি কিনে দিয়েছিলেন তার কর্মস্থলের সুপারভাইজার, যিনি এখন পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন। এই রিসিভার অংশটি যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফায়ারআর্ম’ হিসেবে বিবেচিত এবং তা কিনতে অবশ্যই ব্যাকগ্রাউন্ড চেক প্রয়োজন হয়।
তামুরার কাছে থাকা রাইফেলে ছিল স্কোপ, ফ্ল্যাশলাইটসহ আধুনিক সরঞ্জাম, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি কেবল আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বহন করা হয়নি, বরং একটি পরিকল্পিত হামলার প্রস্তুতি ছিল তার মধ্যে।
লক্ষ্যবস্তু ছিল এনএফএল সদর দপ্তর?
নিউইয়র্ক পুলিশ জানায়, তামুরার হামলার লক্ষ্য ছিল সেই ভবনের ৩৩ তলা, যেখানে এনএফএল-এর কর্পোরেট অফিস অবস্থিত। এটি একপ্রকার প্রতীকী প্রতিশোধ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেখানে ফুটবল খেলাকে দায়ী করে নিজের ট্রমার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তামুরা।
সমাজব্যবস্থার দায়
এই ঘটনার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি কীভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র রাখতে পারেন? তিনি যখন নিজেই বলেছেন যে তিনি আত্মহত্যার কথা ভাবছেন, তখন তার লাইসেন্স বাতিল হয়নি কেন?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, তামুরার মতো অনেকেই আমেরিকায় অস্ত্রের সহজলভ্যতার সুযোগে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। এটা কেবল এক ব্যক্তির সমস্যা নয়, বরং সমাজব্যবস্থার গাফিলতির ভয়ংকর উদাহরণ।
শেইন তামুরার হত্যাযজ্ঞ কেবল চারটি প্রাণের অবসান নয়, বরং একটি বার্তা—মানসিক স্বাস্থ্য ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে এমন আরও তামুরা তৈরি হবে, যারা একদিন হেঁটে ঢুকে পড়বে আমাদের নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে।