ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা দলীয় বিষয়। নির্বাচন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে যাবে না। তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে একেবারে শূন্য হাতে ফিরিনি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে এমনটাই আশা করি। আমরা চাই, সবাই নির্বাচনে আসুক। কেউ যদি নির্বাচনে না আসে সেটা তাদের দলীয় ব্যাপার। তাই বলে আমরা তো সংবিধান বন্ধ করে রাখতে পারি না। আমরা চাই, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকবে।’
সদ্য সমাপ্ত ভারত সফর নিয়ে গতকাল বুধবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা গত সপ্তাহে দিল্লি সফর করেন। সফরে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এসবের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনবিষয়ক সমঝোতা স্মারকও রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সরকারপ্রধান সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। ব্যত্যয়ী কোনো ঘটনা না হলে যেকোনো দেশে রাষ্ট্রীয় সফর করে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের দরজা খোলা : আগামী নির্বাচনে জোটের আকার বড় হবে কি না এ প্রশ্নে নির্বাচন জোটবদ্ধভাবে করার ইঙ্গিত দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ উদারভাবে কাজ করে। আওয়ামী লীগের দরজা খোলা। আমরা ১৪ দল করেছি। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছি। জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচন করেছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা ছিল। ভবিষ্যতে কে কোথায় নির্বাচন করবে সময় তা বলে দেবে। নির্বাচনে যারা সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিল তারা আমাদের সঙ্গেই থাকবে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আর আমাদের সঙ্গে কে থাকবে, কে থাকবে না, নতুন জোট হবে কী হবে না, হলে হোক, অসুবিধা নেই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। কারণ সরকারে আসার পর আমরা যে উন্নয়ন করতে পেরেছি, তা জনগণ জানে। নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, গৃহহীনদের ঘর তৈরি করে দেওয়া, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা আমরা উন্নয়ন করেছি। তৃণমূল পর্যায় থেকে আমরা উন্নয়ন করে যাচ্ছি। এত কাজ করার পর অবশ্যই জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
জেলা পরিষদের প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে জাতীয় নির্বাচনে এমনটি হবে কি না এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘নির্বাচনে মনোনয়ন পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ক্ষেত্রমতো আমরা যাচাই করে দেখব কার জেতার সম্ভাবনা আছে আর কার নেই। কে ভোট পাবে, কে ভোট পাবে না। ভোট পেলে সে জিতবে কি না সব বিবেচনা করে নির্বাচনে নমিনেশন দেওয়া হয়। নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি আছে। সময় যত যাবে ততই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’ জেলা পরিষদে নমিনেশন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হয়তো বেশি দিন বাঁচব না। বয়স হয়ে গেছে। কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি। যাদের নমিনেশন দিয়েছি তাদের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনিনি।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘দীর্ঘদিন টানা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। আপনারা ভুলে গেছেন ৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর কতবার যে ক্যু হয়েছিল। একটা মিলিটারি ডিকটেটরের পর আরেকটা মিলিটারি ডিকটেটর। অথবা মিলিটারি ডিকটেটরের স্ত্রী ক্ষমতা নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। জনগণের কী ছিল তখন? জনগণের আদৌ কোনো অধিকার ছিল? সারা রাত কারফিউ, কথা বলার অধিকার নেই। কে কখন গায়েব হয়ে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। এই তো ছিল বাংলাদেশের অবস্থা। আপনারা এখন টকশো করেন, যে যার মতো কথা বলেন। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার আগে কে এত কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন বলেন তো?’
যে অন্যায় করবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : বিএনপির আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ যারা রাস্তায় আন্দোলন করছে, জনগণ তাদের আন্দোলনে সাড়া না দিলে তো সেটা আমার দায়িত্ব নয়। আওয়ামী লীগ যে বিএনপির হাতে নির্যাতিত হয়েছে সেটা কী ভুলে গেছেন। সবাই তো আওয়ামী লীগের ওপর চড়াও হয়েছে। লাশ টানতে টানতে আর আহতের চিকিৎসা করতে করতে আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। আমাদের পার্টির কেউ যদি অন্যায় করে আমরা ছেড়ে দিই না। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এ জন্য কিছু বলব না, তা নয়। যে অন্যায় করবে তার বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নেব এবং নিচ্ছি।’
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘যারা তত্ত্বাবধায়ক বা ইত্যাদি বলে চিৎকার করছে তারা ওয়ান-ইলেভেনের কথা ভুলে গেছেন? ২০০৭-এর কথা ভুলে গেছেন? কী অবস্থা হয়েছিল! সেখান থেকে তো সবাই মুক্তি পেয়েছেন। ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, চলাফেলার অধিকার, সমালোচনার অধিকার পেয়েছেন। প্রশংসা করার অধিকার সবই তো পাচ্ছেন। কেউ কারও মুখ বন্ধ করে রাখছে না। কাউকে আমরা বাধা দিচ্ছি না। মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা আমি দিয়েছি। এটা তো স্বীকার করতে হবে।’
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ভারত ইতিবাচক : এবার ভারত সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করছে। নিজেদের মধ্যে অস্ত্রবাজি ও সংঘাত করছে। পরিবেশকে তারা আরও নষ্ট করছে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারত ইতিবাচক, তবে সমস্যা মিয়ানমার।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভারতকে আমরা বলেছি তারা যেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতা করে। তাদের ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মিয়ানমারকে নিয়ে। তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত থাকে। ভারত মনে করে, এটার (রোহিঙ্গা ইস্যু) সমাধান হওয়া উচিত।’
ভারত থেকে শূন্য হাতে আসিনি : ভারত সফরে কী পেল বাংলাদেশ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থা চারদিকে ভারত, একটুখানি মিয়ানমার, তারপর বে অব বেঙ্গল। বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, যোগাযোগ সব বিষয়ে সহযোগিতা আমরা পাই।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘নুমালিগড় থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল নিয়ে আসছি। লাইনটা কিন্তু ভারত নির্মাণ করে দিচ্ছে। দিনাজপুরের পার্বতী ডিপোতে এ তেল থাকবে। চট্টগ্রাম থেকে বাঘাবাড়ী হয়ে তেল উত্তরবঙ্গে যেতে হবে না। রিফাইন করা তেল ওখানে আসবে। অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য আরও বাড়বে। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা আমরা দূর করেছি। ভারত থেকে এলএনজি আমদানির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মনে হয় না যে একেবারে শূন্য হাতে ফিরে এসেছি।’
অর্থ পাচারকারী অনেক ‘স্বনামধন্য ব্যক্তির’ তথ্য আমার হাতে : অর্থ পাচারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘অর্থ পাচারকারী অনেকের তথ্য আছে। আমি সোজা কথা বলি, অনেক স্বনামধন্যের তথ্য আমার কাছে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাদের নাম আসবে। সামনে তাদের নাম আসবে। আপনারা ছাপবেন কি না, আমি সেটা দেখব।’
টাকা পাচার ও ডলার সংকট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানি লন্ডারিং বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ডলার সংকট বাংলাদেশের একার নয়, বিশ্বব্যাপী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমেরিকা স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিল, তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেল।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘ডলার নিয়ে একটা খেলা শুরু হয়েছিল কিন্তু ভালোভাবে নজরদারি করা হয়েছে বলেই আজকে একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি আছে। এ সংকট তো আন্তর্জাতিক বিষয়।’
গত ৫ সেপ্টেম্বর চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা, রেলপথ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।










