প্রলয়ঙ্করী ২৯ এপ্রিলের রাত: ম. শামসুল ইসলামের স্মৃতি থেকে
চট্টগ্রাম: ১৯৯১ সালে ম. শামসুল ইসলামের বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। সদ্য ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজও চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেই বিভীষিকাময় রাতের দৃশ্য। হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন তিনি।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় অঞ্চল একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ, আর সর্বস্ব হারায় এক কোটি মানুষ। অথচ সেই ভয়াবহ দুর্যোগের তিন দশক পার হয়ে গেলেও উপকূলে এখনো নেই একটি স্থায়ী, নির্ভরযোগ্য বেড়িবাঁধ।
শামসুল ইসলামের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামে। বাড়ি থেকে পশ্চিমে দেড় কিলোমিটার দূরে ছিল বঙ্গোপসাগর, আর আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত শংখ নদী। সেই ২৯ এপ্রিল, সোমবার সকালে আকাশ ছিল মেঘলা, হালকা বাতাস আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। কিন্তু তীব্র ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তি কমছিল না। দুপুরের পর আবহাওয়া দ্রুত বদলে যেতে থাকে—বাতাসের গতি বাড়তে থাকে এবং বৃষ্টি আরও জোরে নামে। কয়েকদিন আগে আবহাওয়া অফিস নিম্নচাপের পূর্বাভাস দিয়েছিল, যা দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।
বিকেল পাঁচটার পর থেকেই ঝড়ো বাতাসের গতি তীব্র হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার পর থেকে দমকা হাওয়ায় টিনের চালা যেন উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। শামসুল তখন ছিলেন মাটির দেয়াল আর টিনের ছাদ দেওয়া ঘরে—মা ও ভাগিনীর সাথে। রাত ৯টার দিকে তাঁর এক ভাই এসে জানালেন ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কথা এবং নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। কিন্তু তাঁর মা আশ্বস্ত করে বললেন, “বিল-খাল শুকনো, পানি এলেও মাটিতে মিশে যাবে।”
অনেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও তারা থেকে যান। হারিকেনের আলোয় তিনজন একটি ঘরে বসে ছিলেন—বাইরে ঝড়ের গর্জনে আর বৃষ্টির শব্দে অন্য কিছু শোনা যাচ্ছিল না।
রাত ১২টার দিকে জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই শামসুল দেখেন পানি উঠছে ঘরের দেয়াল পর্যন্ত। তড়িঘড়ি করে মা ও ভাগিনীকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। উঠানে তখন কোমরসমান পানি। পরিবার-পরিজনদের নিয়ে তারা আশ্রয় নেন ভিটায় রাখা একটি খড়ের গাদার উপর।
কিন্তু দুর্যোগ এত সহজে ছেড়ে দেয়নি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে দ্বিতীয় দফায় বঙ্গোপসাগরের বিশাল ঢেউ উঠে এসে খড়ের গাদাকে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে নেয়। শামসুলের চোখের সামনেই তাঁর মা, ভাগিনী, আত্মীয়-স্বজন ভেসে যেতে থাকেন উত্তাল জলোচ্ছ্বাসে। প্রাণপণে ধরে রাখার চেষ্টা করেও কাউকেই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
একসময় একটি খালি চালা এসে ভেসে আসে। তিনজন মিলে কোনোভাবে সেটিতে উঠে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রবল স্রোতের তোড়ে সেটিও ভেসে যায়। কিছুক্ষণ পর চালা থেকে ছিটকে পড়ে যান শামসুল। মনে হয়েছিল এখানেই জীবন শেষ। ঠিক সেই মুহূর্তে পানির উপর ভেসে ওঠে একটি কড়ই গাছের গুঁড়ি। প্রাণপণ চেষ্টা করে সেটিকে জড়িয়ে ধরেন। বিশাল বিশাল ঢেউ আসছিল, মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, আর গাছ আঁকড়ে ধরে প্রাণে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যান সারারাত।
রাত ৩টার পর পানি নামতে শুরু করে। ভোরের আলো ফুটতেই গাছ থেকে নেমে আসেন শামসুল। চারদিক তখনও বুকসমান পানিতে ডুবে। ভেসে ভেসে বাড়ির সামনের রাস্তায় পৌঁছান। সেখানে দেখতে পান চারপাশে শুধু লাশ—চিৎ, কাত হয়ে পড়ে থাকা শত শত মানুষের নিথর দেহ। বিবস্ত্র নারী, সন্তান কোলে আঁকড়ে ধরে থাকা মায়ের মৃতদেহ—মর্মান্তিক দৃশ্যগুলো আজও তাঁকে তাড়া করে ফেরে।
বাড়িতে ফিরে দেখেন ঘরবাড়ি সব ভেসে গেছে। তবে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁর মা ও ভাগিনী। খড়ের গাদা ভেঙে ভেসে যাওয়ার পর দুজনেই একটি গাছ ধরে রাতভর মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছিলেন। তবে হারিয়ে যান জেঠাত ভাই ফয়েজ, তার শিশু সন্তান বাদশা ও মেয়ে মুন্নীসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য। অনেকের মরদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শামসুল ইসলাম বলেন, “সেদিন আমার জীবনটাও থেমে যেতে পারতো। হয়তো অজানা লাশের সারিতে আমাকেও খুঁজে পাওয়া যেত না। ভাগ্য সহায় ছিল বলেই ফিরতে পেরেছি জীবনে। কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি আজও বুকের ভেতর শোক হয়ে জমে আছে।”
-ম. শামসুল ইসলাম। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন।