
বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক:
বিশ্বখ্যাত জাপানি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিসান এক গভীর আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বজুড়ে প্রায় বিশ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। এর মধ্যে নতুন করে আরও এগারো হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতি চলছে, যা আগেই ঘোষণা দেওয়া নয় হাজার ছাঁটাইয়ের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠানের মোট জনবলের প্রায় পনের শতাংশ হ্রাসের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
এই বিশাল আকারের কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর প্রথম প্রকাশ করেছে জাপানের জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম এনএইচকে। যদিও এখন পর্যন্ত নিসানের মূল কার্যালয় থেকে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। যুক্তরাজ্যে নিসানের কার্যক্রম পরিচালনাকারী দপ্তরও এখনো নিশ্চিত করেনি এই গণছাঁটাইয়ের খবর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিসান এমন এক সময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, যখন প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববাজারে একের পর এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। বিশেষ করে চীনে তাদের বাজার শেয়ার গত চার বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এক সময় যেই চীনকে লাভজনক বাজার হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেই বাজারেই এখন নিসান ক্রমাগত পশ্চাদপসরণ করছে।
চীনের বাজারে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর দুরন্ত উত্থান নিসানকে রীতিমতো কোণঠাসা করে ফেলেছে। বাইডি, চেরি ও জিলির মতো প্রতিষ্ঠানগুলি বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে যে গতিতে অগ্রসর হয়েছে, তাতে পিছিয়ে পড়েছে জাপানি নির্মাতারা। স্টিফেন মা, যিনি সম্প্রতি নিসানের চীনা শাখার দায়িত্ব নিয়েছেন, স্বীকার করেছেন যে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কার্যকরভাবে বাজার দখল করেছে।
নিসান তাদের বাজার পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে স্থানীয় অংশীদার ডংফেংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে দুটো বৈদ্যুতিক ও দুটো হাইব্রিড গাড়ির ধারণা মডেল উন্মোচন করেছে শাংহাই অটো শোতে। কিন্তু এতদিনে বাজারে তারা যে গ্যাপ তৈরি করেছে, তা পূরণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
চীনের বাইরে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও নিসান একইরকম চাপের মুখে পড়েছে। একসময় এই অঞ্চলে জাপানি গাড়িগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও এখন সেখানে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রাসন বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাপান ও ইউরোপে বিক্রি স্থবির হয়ে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিতে শুল্ক জটিলতা।
নিসান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হাইব্রিড গাড়ির ক্রমবর্ধমান চাহিদা বুঝতে পারেনি বলেই বিশ্বাস করেন বিশ্লেষকেরা। ফলে দেশটির বহু ডিলারশিপে নিসানের হাইব্রিড গাড়ির উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় অনেক গাড়ি অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে, যেগুলো বিক্রি করতে কোম্পানিকে বড় ধরনের ছাড় দিতে হচ্ছে।
জানুয়ারি মাসে নিসান ফ্রান্সের গাড়ি নির্মাতা রেনোর সঙ্গে পুরোনো জোটে ছাঁটাইয়ের পর নতুন কোনো শিল্প অংশীদার খুঁজে পায়নি। ফেব্রুয়ারিতে দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হোন্ডার সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা চললেও সেটিও ব্যর্থ হয়। এই পরিস্থিতিতে নিসানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
মঙ্গলবার নিসান ২০২৪ ২৫ অর্থবছরের আর্থিক ফলাফল প্রকাশ করতে যাচ্ছে। পূর্বাভাসে যেখানে ক্ষতির পরিমাণ আশি বিলিয়ন ইয়েন বলা হয়েছিল, সেখানে এখন সেটি বেড়ে সাতশ থেকে সাতশ পঞ্চাশ বিলিয়ন ইয়েনে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিসানের এই ভয়াবহ আর্থিক দুরবস্থার পেছনে যেমন রয়েছে বাইরের প্রতিযোগিতা ও বাজারের পরিবর্তন, তেমনি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নিজের কৌশলগত দুর্বলতা। পণ্যের বৈচিত্র্য, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং গ্রাহকের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হওয়াই আজকের এই সংকটের মূল কারণ বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাপী নিসানের বহু কর্মী এখন উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের সান্ডারল্যান্ড প্লান্টে নিসানের প্রায় ছয় হাজার কর্মী রয়েছেন, যাদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে তাদের চাকরি হয়তো আর বেশিদিন নিরাপদ থাকবে না।
এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে নিসানকে শুধু জনবল ছাঁটাই নয়, পুরো ব্যবসায়িক কাঠামোয় বড় ধরনের রদবদল আনতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে এই প্রাচীন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়তে পারে।