আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিশ্বজুড়ে বন্যপ্রাণী পাচারের ভয়াবহতা নতুন নয়। কিন্তু ইন্টারপোল ও বিশ্ব শুল্ক সংস্থার সাম্প্রতিক যৌথ অভিযানে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা এই অপরাধজগতের বিস্তার ও প্রভাবকে নতুন করে প্রকাশ করেছে। ‘অপারেশন থান্ডার ২০২৪’-এ অংশ নেয় ১৩৮টি দেশ ও অঞ্চল, যেখানে ৩৬৫ জন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার এবং ২০ হাজারের বেশি জীবিত প্রাণী উদ্ধার করা হয়। এই প্রাণীগুলোর মধ্যে ছিল বাঘ শাবক, বানর, বিষধর সাপ, কচ্ছপ, হরিণ, প্যাঙ্গোলিন ও নানা প্রজাতির পাখি—সবই বিপন্ন বা সংরক্ষিত প্রাণী।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক এই অভিযান কেবল চোরাকারবারিদের গ্রেপ্তারেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি শনাক্ত করেছে ছয়টি আন্তঃদেশীয় অপরাধ চক্র। এদের শিকড় ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পাওয়া গেছে পাচার কাজে ব্যবহৃত ১০০টির বেশি কোম্পানি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।
পাচারের ছক এবং প্রযুক্তির ব্যবহার:
আধুনিক প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন মার্কেটপ্লেস এখন পাচারকারীদের নতুন হাতিয়ার। একাধিক ফেক প্রোফাইল ও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তারা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, এমনকি ডাকঘরের মাধ্যমেও পাচার চলছে প্রাণী ও প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ—বাঘের চামড়া, দাঁত, হরিণের শিং, সাগরের প্রবাল বা সি-কিউকাম্বার পর্যন্ত।
চোরাচালানের নতুন নতুন কৌশলও চমকে দেওয়ার মতো। কেউ শরীরের ভেতরে করে ছোট প্রাণী বহন করছে, কেউ আবার বিশেষ কন্টেইনারে পাচারের আয়োজন করছে। অস্ট্রেলিয়ায় ১৭৩১টি জীবন্ত সরীসৃপ, চিলিতে ৩৩টি বানর, ইরাকে ১২টি ওরিক্স এবং মোজাম্বিকে ১২টি প্যাঙ্গোলিন উদ্ধার হয়।
পাচারের উৎস, গন্তব্য ও বিপন্নতা:
বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বড় অংশই আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সক্রিয়। বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে মরোক্কো, তানজানিয়া ও মেক্সিকো পর্যন্ত—সব জায়গায় পাচারের উৎস রয়েছে। এসব প্রাণীর গন্তব্য প্রধানত চীন, ভিয়েতনাম, লাওস, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ। সেখানে ধনীদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে যে হাতির দাঁত বা বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারে সৌভাগ্য ও শক্তি বৃদ্ধি ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের বিশ্বাস ও বাজারচাহিদা পুরো পাচার চক্রকে টিকিয়ে রাখছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সীমিত ক্ষমতা নিয়ে চেষ্টা চালালেও দুর্নীতি, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের অভাব পাচারকারীদের সুযোগ করে দিচ্ছে বারবার।
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি
বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী পাচার শুধু প্রাণীর অস্তিত্ব নয়, বরং মানবজাতির স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্যও মারাত্মক হুমকি। প্রাণী থেকে মানবদেহে সংক্রমিত রোগের সম্ভাবনা (যেমন করোনা) বাড়ছে এই চোরাচালানের মাধ্যমে। আইইউসিএন ও অন্যান্য পরিবেশবিষয়ক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে প্রাণীবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে এবং নতুন মহামারি দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশও ঝুঁকিতে
বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক এই চক্রের বাইরে নয়। চট্টগ্রাম, টেকনাফ, সাতক্ষীরা, সিলেট সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় বিপন্ন প্রজাতির পাখি, সাপ ও বানর। দেশের ভেতরেও বনাঞ্চল থেকে প্রাণী ধরে পাচারকারীরা বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বন বিভাগ, পুলিশ ও কাস্টমসের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতা পাচার রোধে বড় বাধা।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রাক্কালে এই অভিযান ও পরিসংখ্যান মনে করিয়ে দেয়, বন্যপ্রাণী পাচার আজ আর নিছক পরিবেশবিষয়ক ইস্যু নয়—এটি জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং বৈশ্বিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন। তাই এখনই সময়, আরও শক্তিশালী আইন, আন্তঃদেশীয় তথ্য আদান-প্রদান এবং নাগরিক সচেতনতার সমন্বয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার।