আমিরুল মোমেনিন, ঢাকা: বিশ্ববাজারে চাল রপ্তানির দৌড়ে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে ভারত। সম্প্রতি ২৫ শতাংশ ভাঙা নন-বাসমতি চাল মাত্র ৩৪৯ ডলার প্রতি টন মূল্যে রপ্তানি করে ভারত কার্যত এক ‘মূল্য যুদ্ধ’ শুরু করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড এই দামে পৌঁছাতে পারছে না, যার ফলে বিশ্ববাজারে চাপের মুখে পড়ছে তাদের চাল রপ্তানি।
পাকিস্তান বর্তমানে একই ধরনের চাল রপ্তানি করছে ৩৬৫ ডলারে, ভিয়েতনামের দর ৩৬২ ডলার এবং থাইল্যান্ডের ৩৭৬ ডলার। তুলনামূলকভাবে ভারতের রপ্তানিমূল্য ১০ থেকে ২৭ ডলার কম। এই অস্বাভাবিক মূল্যের ব্যবধান নিয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক প্রশ্ন কীভাবে ভারত এত কম দামে চাল রপ্তানি করছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই কমদামে রপ্তানির পেছনে রয়েছে বিপুল সরকারি ভর্তুকি। দেশটির মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (MSP) অনুযায়ী নন-বাসমতি ধানের প্রতি টনের মূল্য ২৬৫ ডলার। সাধারণত ৬৬ শতাংশ মিলিং রিকভারি ধরে মিলিংয়ের পর চাল উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩৩০ ডলার। এর সঙ্গে যোগ হয় পরিবহন, প্যাকেজিং, বন্দর চার্জসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়—প্রায় ৫৫ ডলার। সব মিলিয়ে প্রতি টন চালের প্রকৃত রপ্তানিমূল্য হওয়া উচিত ৩৮৫ ডলারের মতো। অথচ ভারত ৩৪৯ ডলারে রপ্তানি করছে, অর্থাৎ প্রতি টনে প্রায় ৩৬ ডলার লোকসানে বিক্রি করছে সরকার।
এই ভর্তুকিনীতির কারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। অভিযোগে বলা হয়েছে, ভারত ডোহার চুক্তির ১০ শতাংশ ভর্তুকির সীমা অতিক্রম করেছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির পরিপন্থী।
অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতীয় মূল্যযুদ্ধে সরাসরি জড়ায়নি। বরং দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের মতো গুণগত বাজারে মনোযোগ ধরে রেখেছে। আফ্রিকান বাজারেও তারা কৌশলগত মান ও সরবরাহের ওপর জোর দিয়েছে। এর ফলে ভারতের বাজারে ফেরার পরও পাকিস্তানের চাল রপ্তানি তেমন কমেনি। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে পাকিস্তান ৫৫ লাখ ৪৪ হাজার টন চাল রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ০.৮৭ শতাংশ কম।
তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে পাকিস্তানেরও। খরিফ মৌসুমে চাল উৎপাদন ৩.৭ শতাংশ কমে যাওয়ায় এপ্রিল ২০২৫ থেকে চালের মজুত দ্রুত কমে যাচ্ছে। ফলে এপ্রিল–জুন ২০২৫ ত্রৈমাসিকে রপ্তানি প্রায় ১৫ শতাংশ কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রেও ভারতের কমদামি চাল বাজারে চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে আফ্রিকান ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো মূল্য সংবেদনশীল বাজারে এই প্রভাব বেশি। ফলে এই দেশগুলো তাদের রপ্তানিমূল্য পুনর্নির্ধারণ ও বাজার পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা করছে।
বিশ্বজুড়ে চাল রপ্তানিতে যে মূল্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা শুধু প্রতিযোগিতার প্রশ্ন নয়—এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ন্যায্যতার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। WTO কী সিদ্ধান্ত নেয় এবং ভারত তার রপ্তানিনীতিতে কী পরিবর্তন আনে, তা নির্ধারণ করবে বিশ্ব চাল বাজারের ভবিষ্যৎ গতি।