Home আন্তর্জাতিক নেপালে ভারতের প্রভাব বনাম চীনের উত্থান: হিমালয়ের কূটনৈতিক টানাপড়েন

নেপালে ভারতের প্রভাব বনাম চীনের উত্থান: হিমালয়ের কূটনৈতিক টানাপড়েন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: হিমালয়ের কোলঘেঁষা ছোট্ট দেশ নেপাল দীর্ঘদিন ধরেই দুই পরাশক্তির কৌশলগত টানাপড়েনের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। একদিকে ভারতের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব; অন্যদিকে চীনের আগ্রাসী বিনিয়োগ, পরিকাঠামোগত সহায়তা এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)–এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য রেখে চলছে কাঠমান্ডুর জটিল পররাষ্ট্রনীতি।

নেপালের অবস্থানই তাকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। উত্তরে চীন, দক্ষিণে ভারত—এই দুই বিশাল প্রতিবেশীর মাঝে থাকা নেপাল বহু দশক ধরে ভারতের কৌশলগত বলয়ের মধ্যেই থেকেছে। ভারতের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্ত, শ্রমবাজার, সামরিক প্রশিক্ষণ, এমনকি নেপালিদের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরির সুযোগ—সবই ভারতের একচ্ছত্র প্রভাবকে স্পষ্ট করেছে।

তবে গত এক দশকে চিত্র বদলেছে। ২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধানকে কেন্দ্র করে মধেশিদের বিক্ষোভ এবং তার জেরে ভারতের ওপর আরোপিত ‘অঘোষিত অবরোধ’ অনেকটাই মনোভাবে পরিবর্তন এনেছে কাঠমান্ডুর। তখন থেকেই চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে নেপাল, যাকে অনেকেই ‘ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী প্রতিবাদ’ বলেই চিহ্নিত করেন।

চীন সুযোগ বুঝে এগিয়ে আসে বিআরআই-এর হাত ধরে। ২০১৭ সালে নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেয়। এর মাধ্যমে হিমালয় পেরিয়ে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা, তিব্বতের লাসা শহর থেকে কির্তিপুর পর্যন্ত রেলযোগাযোগ, রাস্তা ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, নতুন বিমানবন্দরসহ একাধিক প্রকল্পে কোটি কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয় বেইজিং।

তবে চীনা অর্থ সহায়তা নিছক সাহায্য নয়—তা উচ্চ সুদের ঋণ, রাজনৈতিক আনুগত্য এবং বৈদেশিক নীতিতে প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবেই দেখা হচ্ছে। অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো ‘ঋণফাঁদ কূটনীতি’র আশঙ্কা নেপালের ক্ষেত্রেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

অন্যদিকে, ভারত এখন আগের মতো নিশ্চিন্ত নয়। দিল্লি নেপালের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংযোগকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় বন্ধন দৃঢ় করতে চাচ্ছে। বিদ্যুৎ রপ্তানি, অবকাঠামোগত সহায়তা এবং ধর্মীয় পর্যটন বিকাশে বিনিয়োগ করে ভারতের ‘সফট পাওয়ার’ ব্যবহারের চেষ্টা বাড়ছে।

এই প্রেক্ষাপটে, নেপাল নিজেকে ‘ভারসাম্য রক্ষাকারী’ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে। ভারত ও চীনের উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজের সার্বভৌম অবস্থান নিশ্চিত করা নেপালের পররাষ্ট্রনীতির মূলে রয়েছে। তবে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন এ ভারসাম্য রক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।

হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে নেপাল এখন শুধু দুই পরাশক্তির ছায়ায় নয়, বরং নিজের কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে একটি আত্মনির্ভর, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই ভারসাম্য কতদিন টিকবে?