কামরুল ইসলাম: এক যুগ আগের কথা। আমি তখন কাজ করি দেশের এক স্বনামধন্য দৈনিকে। সেই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন একজন স্থপতি- পেশায় আর্কিটেক্ট হলেও সাংবাদিকতায় তাঁর দূরদর্শিতা ছিল ঈর্ষণীয়। একদিন, বার্তা বিভাগের নিয়মিত বৈঠকে হঠাৎ তিনি বললেন, “মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখনই বলা মুশকিল।”
তিনি তখন সদ্য ভারত সফর শেষে ফিরেছেন। কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে এসেছেন। সে আলোচনার আলোকেই তিনি সেই আশঙ্কার কথা জানান। তাঁর কথা শুনে আমরা অনেকেই তখন চমকে গিয়েছিলাম। কেউ কেউ সভা শেষে বলেছিলেন, “আর্কিটেক্ট সম্পাদক সাহেব এ কী বললেন!”
আজ তিনি প্রয়াত। কিন্তু সংবাদপত্র শিল্পের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয়, তাঁর সেই কথাগুলো ভবিষ্যতের নির্ভুল চিত্রই এঁকে দিয়েছিল।
এক সময় মুদ্রিত পত্রিকা ছিল খবর জানার একমাত্র অবলম্বন। সকালের চায়ের সঙ্গে ছাপা কাগজ হাতে না পেলে অনেকেই দিন শুরু করতে পারতেন না। অথচ এখন সময় পাল্টেছে। প্রযুক্তির উল্লম্ফনে বদলে গেছে পাঠকের অভ্যাস। মুহূর্তেই খবর পৌঁছে যাচ্ছে স্মার্টফোনের পর্দায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন খবর ছড়ায় আগুনের গতিতে। ফলে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে মুদ্রিত সংবাদপত্র শিল্প।
বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত এক দশকে একাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা তাদের ছাপা সংস্করণ বন্ধ করেছে, কেউ কেউ সীমিত করেছে ছাপা কাগজের সংখ্যা। অনেকেই এখন অনলাইন মাধ্যমকে মুখ্য করে পরিচালিত হচ্ছে। বিজ্ঞাপন আয় কমে যাওয়া, মুদ্রণ ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া, এবং পাঠক হারানোর ফলে মুদ্রিত কাগজের টিকে থাকাই হয়ে উঠেছে কঠিন।
বিশ্বজুড়েই একই চিত্র। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণের পাঠক ছিল প্রায় ৬ কোটি। ২০২৪ সালে এসে সেই সংখ্যা ২ কোটির নিচে নেমেছে। বাংলাদেশেও ছাপানো পত্রিকার বিক্রি কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
তবে সবই কি অন্ধকার? বিশেষজ্ঞরা বলেন, না। পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনই এখন মুদ্রিত পত্রিকার টিকে থাকার একমাত্র উপায়। অনেক সংবাদপত্র এখন প্রিন্ট ও ডিজিটাল এই দুই মাধ্যমের সমন্বয় করে নতুন পথ খুঁজছে। ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন, বিজ্ঞাপন, ভিডিও কনটেন্ট- সব মিলিয়ে একটি নতুন মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে।
বিশ্বাসযোগ্যতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও গভীর বিশ্লেষণ, এই তিন শক্তিকে ধারণ করতে পারলেই সংবাদপত্র আজও পাঠকের আস্থা অর্জন করতে পারে। এখনো এমন অনেক পাঠক আছেন যারা সকালে ছাপা কাগজ হাতে নিয়েই দিন শুরু করতে চান, বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিকরা বা যাঁরা সংরক্ষণে আগ্রহী।
চূড়ান্ত বিচারে বলা যায়, সংবাদপত্র শিল্প এখন এক সন্ধিক্ষণে। দৈনিক থেকে সাপ্তাহিক বা মাসিক, ছাপার ধরন বদলাতে পারে, কিন্তু সাংবাদিকতার চেতনা ও মূল্যবোধ বদলায় না। যাঁরা সত্য বলার সাহস রাখেন, বিজ্ঞাপনের লোভে এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে তথ্য বিকৃতি বা তথ্য গোপন করবেন না, যাঁরা অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেন, তাঁরা মুদ্রিত হোন বা ডিজিটালে সবসময়ই থাকবেন প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক।
প্রয়াত সম্পাদক সাহেব যখন সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অনেকেই বিশ্বাস করেননি। কিন্তু সময় প্রমাণ করেছে, তিনি কতটা দূরদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন এক আর্কিটেক্ট, শুধু ভবনের নয়, ভাবনারও।