Home আন্তর্জাতিক পানামা-ইউরোপ রুটে কোকেন চোরাচালান: সমুদ্রপথেই ছড়ায় মাদক সাম্রাজ্য

পানামা-ইউরোপ রুটে কোকেন চোরাচালান: সমুদ্রপথেই ছড়ায় মাদক সাম্রাজ্য

লন্ডনের গেটওয়ে বন্দরে জুন মাসে উদ্ধার করা কোকেনের চালান। ছবি সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পানামা থেকে লন্ডন, রটারডাম কিংবা হ্যামবার্গ- এই সমুদ্র রুট এখন দক্ষিণ আমেরিকার কোকেন পাচারকারীদের প্রধান করিডর। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডন গেটওয়ে বন্দরে প্রায় ২.৪ টন কোকেন জব্দ হওয়ার ঘটনায় ফের আলোচনায় এসেছে এই রুট। প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার এই কোকেন আনা হচ্ছিল একটি কনটেইনারবাহী বাণিজ্যিক জাহাজে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জাহাজটিতে অভিযান চালায় যুক্তরাজ্যের বর্ডার ফোর্স।
কোথা থেকে শুরু হয় এই চোরাচালান?

এই মাদকচক্রের মূল উৎস দক্ষিণ আমেরিকা। বিশেষ করে কলম্বিয়া, পেরু এবং বলিভিয়া। এই দেশগুলোকে বলা হয় কোকেন উৎপাদনের “গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল”। উৎপাদনের পর মাদক পাচারকারীরা কোকেন পাঠায় ইকুয়েডর, পানামা, ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার বন্দরগুলোতে। এই বন্দরে কন্টেইনারে পণ্য পাঠানোর আড়ালে গোপনে কোকেন ভর্তি করে পাচারকারীরা।

কিভাবে পাঠানো হয়?

সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো “রিপ পন” (rip-on/rip-off) মেথড—এই কৌশলে কনটেইনার লোড হওয়ার পর চোরাচালানকারীরা গোপনে কোকেন ঢুকিয়ে আবার সিল করে দেয়। অনেক সময় চক্রের ভেতরের কিছু বন্দরকর্মী, নাবিক ও ডকার এই কাজে যুক্ত থাকে। মূল কন্টেইনারে বৈধ পণ্য থাকে, আর কোণের ভেতরে বা কাঠের বাক্সের নিচে থাকে প্যাকেটবন্দি কোকেন।

কীভাবে হয় হস্তান্তর?

জাহাজ ইউরোপের বন্দরে পৌঁছালে পাচারকারীদের অন্য শাখা সক্রিয় হয়। কাস্টমস পেরিয়ে যাওয়ার পর কনটেইনার খালাসের সময় মাদক তুলে নেওয়া হয় নির্দিষ্ট স্থান থেকে। কেউ কেউ বন্দরে কর্মরত লোকদের দিয়ে আগেই কনটেইনার শনাক্ত করিয়ে রাখে। কখনো কখনো জাহাজের মাঝসমুদ্রে অবস্থানকালেও ছোট স্পিডবোটে কোকেন তুলে দেওয়া হয়।

কোন রুট সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত?

১. পানামা → স্পেন/বেলজিয়াম/যুক্তরাজ্য
২. ইকুয়েডর → নেদারল্যান্ডস
৩. ব্রাজিল → ফ্রান্স/জার্মানি/বেলজিয়াম

বিশেষ করে পানামার কোলন ফ্রি জোন ও বেলজিয়ামের জিব্রুগ বন্দর এখন ইউরোপে কোকেন প্রবেশের হটস্পট।

কেন সমুদ্রপথ?
  • সমুদ্রপথে নজরদারি তুলনামূলক দুর্বল।
  • একেকটি জাহাজে থাকে কয়েক হাজার কনটেইনার—সব চেক করা প্রায় অসম্ভব।
  • শিপিং ডকুমেন্টে গোপন তথ্য পাওয়া কঠিন, তাই লজিস্টিকস ও পণ্য ট্র্যাকিংয়ের সুযোগ নেয় চক্র।
  • আন্তর্জাতিক নজরদারি ও প্রতিরোধ

যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও স্পেন এখন গোয়েন্দা ভিত্তিক যৌথ অভিযান জোরদার করছে। পানামা, কলম্বিয়া, ব্রাজিলেও চলছে প্রশিক্ষণ ও ডেটা শেয়ারিং প্রোগ্রাম।

বিশেষ ঘটনা

লন্ডনের গেটওয়ে বন্দরে জুন মাসে ভিড়েছিল একটি কনটেইনারবাহী জাহাজ, আর সেখান থেকেই যুক্তরাজ্যের বর্ডার ফোর্স ইতিহাসের অন্যতম বড় মাদক উদ্ধার অভিযান চালায়। জাহাজটি থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ২.৪ টন কোকেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা)।

বন্দরের ডকার এবং বর্ডার ফোর্স কর্মকর্তারা ৩৭টি বড় কনটেইনার ঘেঁটে এই বিপুল পরিমাণ কোকেন খুঁজে পান। হোম অফিস জানিয়েছে, এটি যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে রেকর্ড হওয়া ষষ্ঠ বৃহত্তম কোকেন জব্দের ঘটনা।

এই জাহাজটি এসেছিল পানামা থেকে এবং বেলজিয়ামের জিব্রুগ বন্দরেও এটি যাত্রা করেছিল। অভিযানে নেতৃত্ব দেন বিশেষায়িত সামুদ্রিক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আগেই নজরদারি শুরু হয়েছিল।

বর্ডার ফোর্স জানিয়েছে, “এই জব্দ অভিযান অপরাধচক্রের ওপর বড় ধরনের আর্থিক ও কৌশলগত আঘাত হেনেছে। এটি প্রমাণ করে, আমাদের গোয়েন্দাভিত্তিক উদ্যোগ মাদক সরবরাহ চেইন ধ্বংসে কার্যকর।”

সংস্থার সামুদ্রিক পরিচালক চার্লি ইস্টো বলেন, “এই জব্দকৃত চালানটি আমাদের প্রতিশ্রুতির শক্ত প্রমাণ—যে আমরা অপরাধীদের এক কদম আগেই থাকি। এখন আমরা আগের চেয়ে আরও বেশি বুদ্ধিমত্তা, প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে লড়ছি।”

 এর আগে, একটি তুর্কি জাহাজের ক্যাপ্টেন ‘স্কট ব্রেমেন’ নামের জাহাজে পাচারকারী পাঁচ নাবিকের সন্ধান পেয়ে নিজেই পুলিশকে জানান। জাহাজটি ব্রাজিল থেকে বেলজিয়ামের জিব্রুগ বন্দরে যাচ্ছিল। ঘটনাটি রুটে তীব্র উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত এই কোকেন রুট এখন একটি সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের করিডর। সমুদ্রপথে গোপনে চালানো মাদক সরবরাহ ইউরোপীয় সমাজের নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। গোয়েন্দা নজরদারি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই বিপজ্জনক মাদকের স্রোত থামানো কঠিন।


  • প্রতিবেদনটি শেয়ার করুন, মতামত দিন—সমুদ্রপথের মাদক চোরাচালান কি বন্ধ করা সম্ভব?