লালনের দেশে : পর্ব ৮
মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি কিংবা লালন মেলায় আমরা যেসব বাউল ফকিরদের দেখি, তারা যেন এক রহস্যময় চরিত্র। তারা গান গায়, দেহতত্ত্ব বোঝে, লালনের নাম নেয়, নির্লিপ্তভাবে পথ চলে। কিন্তু এই গানের মানুষদের সংসার কেমন? কীভাবে চলে তাদের প্রতিদিনের জীবন, যখন উৎসবের আলো নিভে যায়?
অনেকের চোখে বাউল জীবন মানে সংসারবিরাগ, কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। অধিকাংশ বাউলই বিবাহিত, তাদের পরিবার আছে, সন্তান আছে, ঘরের হাড়ি আছে, নাড়ির টানও আছে। তারা কৃষিকাজ, মাটি কাটার কাজ, দিনমজুরি, ঝাড়ুদারির মতো কঠিন শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ কেউ হস্তশিল্প কিংবা কুটিরশিল্পেও জড়িত।
কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, নাটোর ও পাবনার গ্রামীণ অঞ্চলে বাউল সম্প্রদায়ের অনেকেই ছোট ছোট দলে বসবাস করেন। সাধনাচর্চা তাদের জীবনের একটি অংশ, কিন্তু তা থামিয়ে রাখে না দৈনন্দিন সংগ্রাম। সকালে মাঠে কাজ, বিকেলে একতারা হাতে নিয়ে গান—এই দুইয়ের মধ্যে তারা খুঁজে নেন জীবনের ভারসাম্য।
নারী বাউলরাও এই জীবনচক্রের অংশ। তারা গৃহকর্ম সামলে গানের চর্চা চালিয়ে যান। কেউ কেউ গুরুর কাছে সাধনার পাঠ নেন। সমাজ এখনও নারীদের বাউলজীবন নিয়ে দ্বিধায় থাকে, তবুও কিছু নারী সাহসিকতার সঙ্গে এই পথ অনুসরণ করেন। তবে তারা নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে হাঁটেন।
বাউলদের কাছে সাধনার অর্থ কেবল আধ্যাত্মিক মুক্তি নয়, বরং তা একটি জীবনদর্শন যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ক্লান্তি সবকিছুর ভেতর দিয়েও সত্যের অন্বেষণ চলে। লালন নিজেই তো বলেছিলেন, “মন রে, রসের সমুদ্দুরে তুই…।” সেই সমুদ্দুরে ডুব দেওয়ার আগে তাদের পাড়ি দিতে হয় দৈনন্দিন লড়াইয়ের কণ্টকময় স্রোত।
বর্তমানে কিছু বাউল সংগঠন মাসিক ভাতা, খাদ্য সহায়তা কিংবা চিকিৎসা সহায়তা পেলেও বেশিরভাগই বঞ্চিত। সরকারি-বেসরকারি সাহায্য আসে মূলত উৎসবকেন্দ্রিক, অথচ এই মানুষগুলো বছরের বাকি সময় বাঁচেন নিঃশব্দ অনটনের মধ্যে।
একজন প্রবীণ বাউল বলেছিলেন, “আমরা গান গাই, মনের জ্বালা দূর করি। কিন্তু পেটের জ্বালা তো গানে মেটে না।” তার কথায় প্রকাশ পায় সেই সত্য, যে বাউল জীবন মানেই কেবল মাধুর্য নয়, তাতে আছে কঠিন বাস্তবতার আঁচড়ও।
তবুও এই সহজ মানুষেরা জীবনকে জটিল করেন না। তারা আত্মার সন্ধানে যেমন মগ্ন, সংসারের দায়ও অস্বীকার করেন না। ঠিক এই দ্বৈততার মধ্যেই তারা ধারণ করেন এক অনন্য দর্শন, যা আজকের সমাজে খুব কমই দেখা যায়।
যারা গান দিয়ে বাঁচে, তারা জীবনকে খুব সহজ করে দেখে। পরবর্তী পর্বে জানুন—ছেঁউড়িয়ায় একদিন: আখড়ার সকাল থেকে সন্ধ্যা, শুধুমাত্র বিজনেসটুডে২৪.কম–এ।