আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বেলুচিস্তানের কোয়েটার কাছে দাগারিতে এক নারী ও পুরুষকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও নিন্দার ঝড়। ঘটনাটিকে ‘অনার কিলিং’ হিসেবে চিহ্নিত করে ইতোমধ্যে পুলিশের বিশেষ অপরাধ তদন্ত শাখা (এসসিআইডব্লিউ)-এর কাছে মামলাটি হস্তান্তর করা হয়েছে।
সোমবার পর্যন্ত এই ঘটনায় মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন এক প্রভাবশালী উপজাতি নেতা—যিনি ওই দম্পতিকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি এক নারী ও এক পুরুষকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মরুভূমির মধ্যে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে মৃতদেহের ওপরও গুলি চালানো হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত দুজনের নাম বানো বিবি ও ইহসানুল্লাহ। তাদের বিরুদ্ধে ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ থাকার অভিযোগ এনে উপজাতি নেতার ‘জিরগা’-র আদেশেই তাদের হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা ঈদুল আজহার তিন দিন আগে সংঘটিত হয়েছিল।
এফআইআর অনুযায়ী, ৮ জন সশস্ত্র ব্যক্তি হত্যায় সরাসরি জড়িত এবং আরও ১৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে।
This was an honor killing in Balochistan, Pakistan, which is not an act of humanity but rather resembles Israeli brutality.
This is totally against islam.
ISLAM says;
If they truly love, then there's no bond better than Nikah. pic.twitter.com/iSg0x8uKGQ— Ukht Irum Fatima (@Irum_Fatimaa) July 20, 2025
গ্রেপ্তারদের মধ্যে অন্যতম উপজাতি নেতা সরদার শেরবাজ সাতকজাইকে সোমবার সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে দুই দিনের পুলিশ রিমান্ডে পাঠান। বেলুচিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রোজি খান বাররেচ ঘটনাটি নজরে নিয়ে প্রাদেশিক সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তলব করেছেন।
ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে নিন্দার ঝড় উঠেছে। পিপিপির এমএনএ শাজিয়া মাররী জাতীয় সংসদে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা চেয়ে স্থগিত প্রস্তাব আনেন। তিনি বলেন, “এই নির্মমতা শুধু ইসলামের শিক্ষা ও সংবিধান লঙ্ঘন করে না, বরং মানবতা ও সভ্যতার ওপর সরাসরি আঘাত।”
প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও হত্যাকাণ্ডকে ‘নৃশংস ও বর্বর’ বলে অভিহিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী সরফরাজ বুগটি জানান, “এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা যে গোত্রেরই হোক, কেউ ছাড় পাবে না। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে ধরা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “নারীটির পাঁচ সন্তান রয়েছে, পুরুষটিরও রয়েছে চার-পাঁচটি সন্তান। তারা বিবাহিত ছিলেন না, কিন্তু তাতেই তাদের হত্যা করার কোনো অধিকার কারও নেই। এটি হত্যা, এটি অপরাধ—অবৈধ সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এভাবে জীবন কেড়ে নেওয়া চলতে পারে না।”
বলা হচ্ছে, ভিডিওটি হত্যাকারীরাই ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়—মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য। মুখ্যমন্ত্রী বুগটি দাগারির দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন ঘটনায় নিষ্ক্রিয়তার জন্য।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এই ঘটনার ভিডিও এক্স প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করে বলেন, “যারা রাষ্ট্রবিরোধী অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, তারা আগে নিজেদের সমাজের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলুন।”
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস কমিশন অফ পাকিস্তান জানায়, ২০২৪ সালে অন্তত ৩৪৬টি ‘অনার কিলিং’ ঘটেছে, যেগুলোর বেশিরভাগই সিন্ধ ও পাঞ্জাবে।
সিনেটর শেরি রেহমান বলেন, “জিরগার নামে বিচারহীন এই হত্যাকাণ্ড সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখে চরম অপমান। এই বর্বর প্রথা রুখতে অবিলম্বে আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।”
বেলুচ নারী অধিকারকর্মী সাম্মি দীন বলেন, “নারীর সম্মান মানে তাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার দেওয়া। আজকের নারী শিক্ষিত, সচেতন এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিজে নির্ধারণ করতে সক্ষম।”
বেলুচিস্তানের এই হত্যাকাণ্ড যেন পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘অনার কিলিং’ প্রথার বিরুদ্ধে এক যুগান্তকারী বিচারিক পরিণতির উদাহরণ হয়ে ওঠে—এমনটাই প্রত্যাশা করছেন নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা।