বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: ঘটনাটি যেন সিনেমার কোনো করুণ দৃশ্য নয়, বাস্তব ঢাকা শহরের মাইলস্টোন স্কুলের রক্তাক্ত ইতিহাস। শিশুদের চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা, আর এক নারীর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ২০টি জীবন রক্ষা করার মহাকাব্যিক সাহস এই দৃশ্য ভুলে থাকা যাবে না কোনোদিন।
সোমবার সকালে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে গেলে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। চারপাশে আগুনের গোলা, ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া শ্রেণিকক্ষ, শিশুদের আতঙ্কিত কান্না। এমন বিভীষিকার মধ্যেই সামনে আসেন একজন শিক্ষক—মাহরিন চৌধুরী। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কো-অর্ডিনেটর মাহরিন চৌধুরী।
তাঁর নিজের প্রাণের কথা না ভেবে, তিনি এক এক করে টেনে বের করেছেন শিশুদের আগুনের হাত থেকে। যে করিডোর দিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল, সেই পথ পেরিয়ে তিনি দৌড়ে গেছেন—যেখানে আটকে ছিল ছোট ছোট প্রাণ। একজন শিক্ষিকা হিসেবে তার কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, তিনি একজন অভিভাবক।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের একজন জানায়, ‘আম্মু (মাহরিন ম্যাডামকে তারা এই নামে ডাকে) চিৎকার করে বলছিলেন, “ভয় পেয়ো না, আমি আছি।” তিনি আমাদের ঠেলে বের করে দিচ্ছিলেন, নিজে ধোঁয়ার ভেতর ঢুকছিলেন বারবার।’
হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা যায়, নিজের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলেছেন মাহরিন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানান, তাঁর শরীরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পুড়ে গিয়েছিল। তবে তিনি একবারও জ্ঞান হারাননি। শেষ মুহূর্তে তিনি বলেন, “আমি ওদের বাঁচাতে পেরেছি তো?”
মাহরিনের পরিবার জানায়, তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। নিজের সন্তান ছিল না, কিন্তু স্কুলের সব শিক্ষার্থী ছিল তাঁর সন্তানের মতোই। তাঁর ভাই বলেন, ‘মাহরিন বলত, ওরা আমার বাচ্চা। আমি না থাকলেও যেন ওরা বাঁচে, সেটাই ওর চাওয়া ছিল।’
উত্তরা এলাকায় এখন শুধু কান্না আর প্রার্থনার শব্দ। শিক্ষার্থীরা বলছে, ‘আমরা বই নিয়ে স্কুলে যাবো, কিন্তু ম্যাডাম আর থাকবেন না। কিন্তু তাঁর সাহস আমাদের পথ দেখাবে।’
একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমার সন্তান হয়তো বেঁচে আছে মাহরিন ম্যাডামের জন্য। এমন মানুষ এ যুগে দেখা যায় না।’
মাহরিন চৌধুরীর চলে যাওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তেমনি তৈরি হলো এক অমর দৃষ্টান্ত। শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—জীবন দিয়ে অন্যকে রক্ষা করাও এক শিক্ষা।
তিনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন, শিক্ষকতা পেশা শুধু পেশা নয়—এটি ভালোবাসা, এটি আত্মত্যাগ, এটি বীরত্বের সর্বোচ্চ রূপ।