বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, নীলফামারী: ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে শিক্ষকতা করতেন মাহরীন চৌধুরী। সোমবার দুপুরে কলেজ চত্বরেই ঘটে যাওয়া এক বিমান দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন এই শিক্ষিকা। মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় নিজ গ্রাম নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ীতে। সেখানে চোখের জলে তাঁকে বিদায় জানায় হাজারো মানুষ।
মাহরীন চৌধুরী ছিলেন বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। গ্রামের চৌধুরী পরিবারের এই কন্যা ছিলেন শিক্ষা ও সমাজসেবায় নিবেদিতপ্রাণ। ঈদের সময় কিংবা ছুটি পেলেই গ্রামের গরিব মানুষদের পাশে দাঁড়াতেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নীরবে কাজ করতেন। এমনকি গ্রামের কালভার্ট নির্মাণেও আর্থিক সহায়তা করেছেন তিনি।

জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয় বিকেল সাড়ে তিনটায় বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে। জানাজায় অংশ নিতে মাঠজুড়ে জনসমুদ্র সৃষ্টি হয়। এর আগে ঢাকাফেরত অ্যাম্বুলেন্সটি বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে গ্রামে পৌঁছালে তাঁর বাবার বাড়িতে মানুষের ঢল নামে। যারা জীবিত মাহরীনকে পেয়েছেন, তারা নিথর দেহটি এক নজর দেখতে ভিড় করেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জানাজার পূর্ব মুহূর্তে তাঁর স্বামী মনছুর হেলাল শোকার্তদের উদ্দেশ্যে বলেন,
‘আমার স্ত্রী এই গ্রামের সন্তান ছিলেন। আপনাদের ভালোবাসতেন। আজকের এই উপস্থিতি তার প্রতি সেই ভালোবাসার প্রতিদান। তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করেছেন। এই দুঃসময়ে আমার পরিবারের পাশে থাকার জন্য আপনাদের সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’
বিমান দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে তিনি জানান,
‘ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। মাহরীন সামান্য আহত হলেও বুঝতে পারেন, বেশ কিছু শিক্ষার্থী ভেতরে আটকা পড়েছে। তিনি মোবাইলে আমাকে বিষয়টি জানান এবং নিজেই তাদের উদ্ধারে ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টার পর তাঁর মৃত্যু হয়।’
জানাজায় অংশ নেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম, উপজেলা জামায়াতের আমীর মোখলেছুর রহমান মাস্টার, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী কমেট, ইউএনও জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন,
‘মাহরীন চৌধুরী একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। তিনি কারো সঙ্গে অন্যায় করেননি, অন্যায় কাজে জড়াননি। তাঁর মতো শিক্ষানুরাগী মানুষ আজ বিরল।’
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল হালিম বলেন,
‘এমন মানুষ একশো বছরে একবার আসে। তিনি গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েদের পাশে ছিলেন, স্কুলের ভবনের জন্য অর্থ দিয়েছেন। আমরা আজ একজন আদর্শিক কন্যাকে হারালাম।’
জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। মাটি দেওয়া শেষে এক মুহূর্তের জন্য যেন থমকে যায় পুরো গ্রাম। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে কান্না আর নিঃশব্দ শোকের ভারে। বগুলাগাড়ীর আকাশ আজ যেন কিছুটা বেশি মেঘলা, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে না বলা কষ্ট। যিনি প্রতি ঈদে গরিবদের হাতে কাপড় তুলে দিতেন, সেই মানুষটিকে আজ কবরে শুইয়ে দিতে হলো। এ যেন কেবল এক শিক্ষক নয়, এক আদর্শিক আলোকবর্তিকাকে হারানোর বেদনা।