ভ্রমণ কাহিনি: দেশ থেকে দেশে
সাইয়েদ আহমেদ
নেপালের পাহাড়ি পথ, তার নির্জনতা আর কুয়াশার কোলাহলে ঢাকা এক ভিন্ন জগৎ। পাহাড়ের তুষারময় চূড়া থেকে শুরু করে ছোট ছোট গ্রাম, নদীর স্বচ্ছ জল থেকে দূরের মেঘলা আকাশ—সবকিছু যেন একসাথে মিলেমিশে এক গভীর নীরবতা তৈরি করে। আমি সেই নীরবতার মাঝে প্রবেশ করেছিলাম, যেখানে শব্দের জায়গা অনেক আগে থেকে দখল করে নিয়েছে স্মৃতির মৃদু স্পর্শ।
চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে প্রথম যে অনুভূতি পেলাম, তা ছিল এক নিঃসঙ্গতা। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, আর মাঝে মাঝে দেখা মিলছে গাঢ় সবুজের ছোট ছোট বুনো জঙ্গল আর বাঁকানো পথে হাঁটতে থাকা মানুষ। তাদের মুখে ফুটেছে অচেনা হাসি, কিন্তু চোখে যেন এক অনুযোগ্য দুঃখের আভাস।
এক গ্রামে পৌঁছে আমি একটি ছোট খামারের বাড়িতে ডাক দিলাম। সেখানে একজন বৃদ্ধা অমায়িক হাসি নিয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। তাঁর কাছে আমার কাছে ছিল একটি পুরনো চিঠি, যা বহু বছর আগে লেখা হয়েছিল, কিন্তু কখনো গন্তব্যে পৌঁছায়নি। সেই চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম এক পুরাতন বাজার থেকে। তাতে লেখা ছিল হারানো ভালোবাসার গল্প, পাহাড়ি পথে হারিয়ে যাওয়া মানুষের বেদনা।
বৃদ্ধা জানান, অনেক আগে তার পুত্রবধূ এই পাহাড়ি পথে যাত্রা করেছিলেন, কিন্তু সে চিঠিটা কখনোই তার কাছে পৌঁছায়নি। সেই মুহূর্তে চোখের কোণে জল জমে এল। আমি বুঝতে পারলাম, এই নির্জন পাহাড়গুলো শুধু নিঃশব্দ নয়, এখানে কথা বলে সময় আর স্মৃতি। পাহাড়ের প্রতিটি গুহা, প্রতিটি ঝর্ণা যেন সেই হারানো চিঠির ভাষা বোঝে।
রাত নামতেই আকাশে ঝলমল করে উঠল অসংখ্য তারা। পাহাড়ের শীতল বাতাসে আমি বসে ছিলাম ছোট একটি কুঁড়েঘরের সামনে, হাতে সেই পুরনো চিঠি। ভাবছিলাম, কতবার কোনো কথা শেষ হওয়ার আগে হারিয়ে যায়, কিংবা সময়ের গা ঢাকা দেওয়ায় আর পৌঁছাতে পারে না ঠিক স্থানে। সেই চিঠির মতো অনেক অনুভূতি আজও হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের নীরব ভাষায়।
নেপালের এই পথগুলো আমাকে শিখিয়েছে, নিঃশব্দতাও ভাষা হতে পারে। হারিয়ে যাওয়া চিঠির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, কিছু সম্পর্ক হয়তো আর ফিরে আসবে না, কিন্তু তাদের ছায়া থেকে যাওয়াটা মানেই হয়তো ভালোবাসার অন্য এক রূপ।
আপনিও যদি কখনো একাকিত্ব আর স্মৃতির মাঝে হারাতে চান, তাহলে নেপালের পাহাড়ি পথে আসুন। সেখানে হয়তো খুঁজে পাবেন হারানো কোনো চিঠির গল্প, যা কখনো শেষ হয়নি।