Home সারাদেশ রিকশার পেছনে লুকানো কারিগরের ঘাম

রিকশার পেছনে লুকানো কারিগরের ঘাম

ছবি এ আই
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কুমিল্লা:দূর থেকে শুনলে মনে হয় একটানা ধাতব শব্দ, কাছে গেলে বোঝা যায় সেটা রিকশার চেইন ঠিক করার আওয়াজ। এই শব্দে ঘামে ভেজে আছে একজন মানুষের জীবন। তার পরিচয় নেই বিজ্ঞাপনের ব্যানারে, নেই টেলিভিশনের আলোয়। তবু শহরের হাজারো রিকশাচালকের চলার পেছনে আছে সেই নিরব কারিগরের শ্রম, যিনি প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সাইকেলের চেইন-গিয়ার-চাকা সারিয়ে সংসার টানেন।

কান্দিরপাড় মোড়ে এমন একজন রিকশা সারাই কারিগরের সঙ্গে দেখা। নাম মোহাম্মদ সিরাজ। বয়স পঞ্চাশের কোটায় হলেও মুখে যেন ক্লান্তির ছাপ আরও পুরনো। তাঁর কথায়, “আঠারো বছর বয়সে হ্যান্ডেলে হাত দিছি, এখন আমার হাত চলে না, গিয়ার চলে।”

সিরাজের ছোট্ট দোকানটির পেছনে এক গজ জায়গায় তিনটি রিকশা রাখা। সামনে মাটি চাপা তেলের কৌটা, হাতুড়ি, স্ক্রু-ড্রাইভার, প্লাস আর টুকরো চেইন। সকাল সাতটায় দোকান খোলেন, চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আয়-রোজগার নির্ভর করে কাজের ওপর। প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে পাঁচটি রিকশার সারাই করতে হয়। একেকটি চেইন পাল্টাতে লাগে একশ থেকে দেড়শ টাকা। তবে সব টাকা হাতে আসে না—কিছু দেনা থাকে, কিছু মাটিতে পড়ে যাওয়া পয়সা।

তিনি বলেন, “বিকালে কোনোদিন ১২০০ টাকা হয়, কোনোদিন ছ’ সাত শো’। রোজগার যা হয়, তা দিয়ে চাল, ভাত আর বাচ্চার স্কুল ফি চলে না। দুই ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, সংসারে টানাটানি।”

শুধু সিরাজ নন, তার আশপাশের আরও কয়েকজন কারিগরের অবস্থাও প্রায় একই। শহরের কোণায় কোণায় রিকশা চলে, কিন্তু এসব রিকশার স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যাঁরা দিনভর খেটে যান, তাঁদের স্বাস্থ্য বা ভবিষ্যতের দিকে কেউ তাকায় না। একবার গুরুতর অসুস্থ হলে বন্ধ হয়ে যায় আয়ের পথ। নেই কোনো স্থায়ী দোকান, নেই সরকারি কোনো সহায়তা।

প্রতিদিন ভাঙা চেইন জোড়া দিতে দিতে একসময় নিজের জীবনের চেইনটাই যেন আলগা হয়ে আসে। তবু থেমে থাকেন না। কারণ তিনি জানেন, থামা মানেই সংসারে ক্ষুধা বাড়া। তাঁর চোখে নেই কোনো স্বপ্নের নগর, শুধু আছে পরিশ্রমে টিকে থাকার বাস্তবতা। মাঝে মাঝে ক্লান্ত হাতে চায়ের কাপ ধরে বলেন, “শুনি গাড়ির যুগ আইছে, রিকশা একদিন থাকব না। তখন আমরা কোথায় যাব?”

রিকশার এই চেইনের শব্দ যেন শহরের শিরায় শিরায় বয়ে চলা এক নীরব সংগীত, যেটার মূল সুর তৈরি করেন এইসব অবহেলিত কারিগর। তাঁদের গল্প কেউ শোনে না, তবে শহরের গতি তাদের হাতের ঘূর্ণিতে জড়িয়ে থাকে প্রতিনিয়ত।