বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, বাগেরহাট : প্রায় এক হাজার ৪৬ কিলোমিটার নৌপথ ঘুরে বেরিয়েছে সুন্দরবনের পাঁচটি কুমির। তবে লবণাক্ত পানির কারণে তাদের পিঠে লাগানো স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার নষ্ট হওয়ায় বর্তমানে বনবিভাগ তাদের অবস্থান জানাতে পারছে না।
যদিও স্যাটেলাইট সচল থাকার সময় পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে কুমিরদের অধিক্ষেত্র, ঘোরাফেরা ও জীবনাচরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন গবেষকরা। এই গবেষণা আগামীতে বিলুপ্তপ্রায় নোনা পানির কুমির রক্ষায় নীতি ও পদক্ষেপ নির্ধারণে সহায়তা করবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।
গবেষণা যাত্রা
২০২৪ সালের ১৩ মার্চ সুন্দরবনে প্রথমবারের মতো দুটি কুমিরের পিঠে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। এরপর আরও তিনটি কুমিরের শরীরে স্যাটেলাইট বসিয়ে সুন্দরবনের খালে অবমুক্ত করা হয়। ট্রান্সমিটার সচল থাকার সময়কাল ছিল সর্বনিম্ন ৫২ দিন থেকে সর্বোচ্চ ১২৭ দিন। এই সময়ের মধ্যে কুমিরগুলো ১,০৪৬ কিলোমিটার নৌপথ ঘুরেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, চারটি কুমির সুন্দরবনের নির্দিষ্ট এলাকায় ঘোরাফেরা করেছে। আর ‘প্রাকৃতিক জোংড়া’ নামের একটি কুমির বাগেরহাট, বরিশাল ও পিরোজপুর ঘুরে আবার সুন্দরবনে ফিরে এসেছে। শিকার ধরা, খাবার সংগ্রহ এবং ডিমপাড়ার জন্য কুমিরগুলো দিনে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার এলাকায় ঘোরাঘুরি করে।
কেন স্যাটেলাইট লাগানো হলো
বাংলাদেশে সুন্দরবন ছাড়া অন্য কোথাও লোনা পানির কুমির দেখা যায় না। বনবিভাগের ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে লোনা পানির কুমিরের সংখ্যা ১৫০–২১০। তবে প্রজাতির বংশবিস্তার দিন দিন কমছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন লোনা পানির কুমিরকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কুমিরের সংখ্যা বাড়াতে ২০০২ সালে সুন্দরবনের করমজলে ‘কুমির প্রজনন কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে সেখানে ৯২টি কুমির আছে। প্রজনন কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া ২০৯টি কুমির বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনের নদী ও খালে অবমুক্ত করা হয়েছে।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, “কুমিরের জীবনাচরণ, অধিক্ষেত্র, ঘোরাফেরা এবং বনের বাইরে যাওয়ার বিষয়গুলো আগে অজানা ছিল। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য এসব তথ্য জানা।”
কুমিরদের পরিচয়
গবেষণার সুবিধার্থে ৫টি কুমিরকে বিভিন্ন স্থানে থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং তাদের নাম দেওয়া হয়। জুলিয়েট, মধু ও পুটিয়া স্ত্রী কুমির। হাড়বাড়িয়া ও জোংড়া পুরুষ।
- জুলিয়েট: করমজল প্রজনন কেন্দ্র থেকে, ২২ বছর ধরে অসংখ্য ডিম দিয়েছে।
- মধু: যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি থেকে উদ্ধার।
- পুটিয়া: করমজল প্রজনন কেন্দ্রে জন্ম।
- জোংড়া: শরীয়তপুরের পাজলাকান্দি থেকে উদ্ধার।
- হাড়বাড়িয়া: সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া খাল থেকে সংগ্রহ।
২০২৪ সালের ১৩–১৫ মার্চ কুমিরগুলো সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি পুটিয়া নামে কুমিরটি চরপুটিয়া খালে ছাড়া হয়।
গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল
- জুলিয়েটের স্যাটেলাইট ৭১ দিন, মধুর ১২৭ দিন, পুটিয়ার ৮৩ দিন, হাড়বাড়িয়ার ৫২ দিন এবং জোংড়ার ৬৪ দিন সচল ছিল।
- জোংড়া কুমির সুন্দরবনের বাইরে গিয়ে বাগেরহাট, বরিশাল ও পিরোজপুর অঞ্চলে ঘোরাফেরা করেছে।
- প্রতিদিন ঘোরাফেরা করা দূরত্বের মধ্যে হাড়বাড়িয়া ৫২ দিন একই খালে সীমাবদ্ধ ছিল, আর মধু দৈনিক মাত্র আধা কিলোমিটার পথ হেঁটেছে।
গবেষণা দলের প্রধান এ বি এম সরোয়ার আলম দীপু বলেন, “কুমিরের দৈনন্দিন পথচলা, অধিক্ষেত্র এবং বনের বাইরে যাওয়ার ধারা সম্পর্কে আগে কোনো ধারণা ছিল না। এই গবেষণা অনেক অজানা তথ্য সামনে এনেছে। আগামীতে আরও ১০–১৫টি কুমির মনিটরিং করা গেলে পুরো চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে।”